দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী অঞ্চলে মৎস্য ব্যবসা লাভজনক একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। এখানে সাগর থেকে মাছ আহরণ, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণনসহ বিভিন্ন সুযোগ রয়েছে। এ কারণে মাছের ব্যবসা স্থানীয়দের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তবে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর অন্যতম মৎস্যবন্দর কুয়াকাটা, আলীপুর ও মহিপুরের মাছ ব্যবসায়ীরা নানা কৌশল আর অজুহাতে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। এসব মৎস্যবন্দরে প্রতিদিন কোটি টাকার মাছ বেচাকেনা করলেও সরকার পাচ্ছে না সঠিক রাজস্ব। রাজস্ব বিভাগের জোরালো তৎপরতা না থাকায় সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। ফলে এই খাতে কর ফাঁকি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পটুয়াখালীর মহিপুর, আলীপুর ও কুয়াকাটা মৎস্যঘাটগুলোতে প্রতিদিন কোটি টাকার মাছ বিক্রি হচ্ছে। বিপরীতে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছে না। মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীরা সরকারি অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি) এড়িয়ে মাছ কিনে নিজেদের ঘাটে মজুত করেন। পরে সেখান থেকে আড়ালে বড় আকারে লেনদেন হয়, যা রেকর্ডে আসে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব ফাঁকি ঠেকাতে ডিজিটাল ওজন মেশিন, অনলাইন চালান ও ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত ঘাটগুলোকে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। মৎস্য খাতে সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর জন্য স্থানীয় প্রশাসন, রাজস্ব বিভাগ ও মৎস্য অধিদপ্তর একযোগে কাজ করলে প্রতি বছর ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় সম্ভব।
মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, উপকূলীয় জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলার ঘাটগুলোতে বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। কিন্তু এর বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয় মাত্র ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা। অথচ সঠিক নিয়ন্ত্রণে থাকলে এ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হওয়ার কথা।
জানা গেছে, ২০২১ সালে উদ্বোধনের পর থেকে ব্যবসায়ীরা আলীপুর ও মহিপুর অবতরণ কেন্দ্রে মাছ বেচাকেনা করছেন। ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য মহিপুর ও আলীপুর প্রান্তে আলাদাভাবে অফিস ভবন, ৪০ কক্ষবিশিষ্ট আড়ত ভবন, ১০ হাজার বর্গফুটের একটি অকশন শেড, ২ হাজার বর্গফুটের একটি প্যাকিং শেড, একটি পর্যবেক্ষণ কক্ষ, ১০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বরফকল, একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দোতলা আবাসিক ভবন, একটি পাম্প হাউস, দুটি নিরাপত্তা কক্ষ, একটি গণশৌচাগার, ৭ হাজার বর্গফুট আয়তনের ট্রাক পার্কিং এবং নদীর দিকে একটি গ্যাংওয়ে ও একটি পন্টুন নির্মাণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত হিসেবে শুধু আলীপুরে দুটি অকশন সেট নির্মাণ হয়েছে। এ দুটি কেন্দ্রে প্রতিদিন পাইকার, ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁক-ডাকে সরগরম থাকে।
আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এ ব্যাপারে একটি হিসাব দিয়েছেন। তার হিসাবমতে, গত ১৩ জুলাই এফবি সাদিয়া-২ নামের ট্রলার বিভিন্ন সাইজের ৬৫ মণ ইলিশ বিক্রি করেন ৩৯ লাখ ৬০ হাজার ১৪০ টাকায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী রাজস্ব আসে ৪৯ হাজার ৫০১ টাকা। কিন্তু আড়তদার-ব্যবসায়ী রাজস্ব দিয়েছেন মাত্র ২ হাজার টাকা। ২ হাজার টাকা হিসাবে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের খাতায় ১২৮ কেজি (৩ মণ ৮ কেজি) মাছ লেখা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, মহিপুরের ব্যবসায়ীরা সরকারি বিএফডিসি মার্কেট ব্যবহার না করতে আলীপুরের ব্যবসায়ীদের চাপ প্রয়োগ করায় রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না।
আলীপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘খাপড়াভাঙ্গা নদীর দুই পাড়ে দুটি মৎস্যবন্দর। মহিপুরের ব্যবসায়ীরা অবতরণ কেন্দ্রে না গিয়ে নিজস্বভাবে মাছ কেনাবেচা করছেন। এতে সরকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। ফলে জেলেদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ তারা কোনো টাকা কাটা হচ্ছে না। আমরা জেলেদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ টাকা কাটলেই শুরু হয় নানা বিপত্তি। তাই আমরা সঠিকভাবে সরকারের রাজস্ব পরিশোধ করতে পারছি না।’
আরেক ব্যবসায়ী আব্দুল মন্নান ব্যাপারী বলেন, ‘মহিপুরের ব্যবসায়ীরা সরকারি মার্কেটে মাছ ক্রয়-বিক্রয় করে রাজস্ব দিলে আমরাও সঠিকভাবে সরকারি রাজস্ব দেব। অন্যথায় আমরা জেলেদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ টাকা কাটলে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।’
এদিকে জায়গার স্বল্পতার অজুহাতে মহিপুরের ব্যবসায়ীরা অবতরণ কেন্দ্রে যাচ্ছেন না। তারা খাপড়াভাঙ্গা নদীর তীরে নিজস্বভাবে মাছ কেনাবেচা করছেন। ফলে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায় করতে পারছেন না। মহিপুরের ব্যবসায়ীদের দাবি, মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটিতে ৪৫ জন ব্যবসায়ীর কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মহিপুর নিবন্ধিত ব্যবসায়ী রয়েছেন ৮২ জন। এই অবতরণ কেন্দ্রের পন্টুনে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ১০টি ট্রলার মাছ খালাস করতে পারে। কিন্তু ট্রলার রয়েছে হাজারেও বেশি। এ ছাড়া এখানে পাইকার আছেন ২০০ জন, শ্রমিক রয়েছেন ৮০০ জন। এত লোকের উপস্থিতিতে মাছ ক্রয়-বিক্রয় করার জায়গা এখানে নেই। তারা একবার শীতের মৌসুমে অবতরণ কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। জায়গার স্বল্পতার কারণে শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিদিন মারামারি হয়। তাই নিজস্ব জায়গায় ফেরত এসেছেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, আলীপুরে ২৫-৩০ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন। আলীপুর অবতরণ কেন্দ্রে যে জায়গা আছে, তাতে মাছ ক্রয়-বিক্রয় সম্ভব।
মহিপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী মো. মজনু গাজী বলেন, এত অল্প জায়গায় আমাদের ব্যবসা করা সম্ভব না। বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ আমাদের পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা করলে আমরা সেখানে যাব। আমরা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করতে চাই না।
আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাজু আহম্মেদ রাজা বলেন, ‘বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) কর্তৃপক্ষ যখন অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তখন প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা না করে কিছু অব্যবসায়ীর সঙ্গে সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে কারণে অবতরণ কেন্দ্রে ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। এখন আমাদের দাবি পূরণ করলে আমরা অবতরণ কেন্দ্রে যেতে রাজি আছি।
আলীপুর ও মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘মহিপুরের ব্যবসায়ীরা অবতরণ কেন্দ্র ব্যবহার না করায় রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। আর এই অজুহাতে আলীপুরের ব্যবসায়ীরা নামমাত্র রাজস্ব দিচ্ছেন। ফলে প্রায় ২৯ কোটি টাকার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে শুধু ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ১১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা লোকসান গুনছে বিএফডিসি।
জায়গার স্বল্পতার বিষয়টি স্বীকার করে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পরিধি বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছে। এ ছাড়া, রাজস্ব ফাঁকি ঠেকাতে ডিজিটাল ওজন মেশিন, অনলাইন চালান ও ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :