দীর্ঘ চার বছর পর জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার হলো মিয়ানমারে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল বৃহস্পতিবার দেশটিতে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেয় জান্তা সরকার। ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং এ-সংক্রান্ত একটি লিখিত আদেশ জারি করেন।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে এক অডিও বার্তায় জান্তা মুখপাত্র জৌ মিন তুন জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পথ সুগম করতে পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। নির্বাচন সামনে রেখে বৃহস্পতিবার থেকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হলো। আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন।’
এর আগে গত ৮ মার্চ এক অনুষ্ঠানে জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লেইং ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ডিসেম্বর কিংবা ২০২৬ সালের মধ্যে মিয়ানমারে নির্বাচন হবে। জৌ মিন তুনের অডিও বার্তাডও সেই ইঙ্গিত পাওয়া গেল। নির্বাচনের তারিখ অবশ্য এখনো জানা যায়নি। মিয়ানমারে সবশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০২০ সালের নভেম্বরে। সেই নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১ নভেম্বর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে। ক্ষমতা দখলের পর সামরিক সরকারের প্রধান হন সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার। গ্রেপ্তার হন সু চি ও তার দলের বিভিন্ন স্তরের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী। এরপর থেকে দেশজুড়ে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। এতে হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মিয়ানমারে সম্ভাব্য নির্বাচনের যে পরিকল্পনা ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার ঘোষণা করেছে, সেই পরিকল্পনার সমালোচনা, প্রতিবাদ কিংবা নির্বাচন বানচালের জন্য কোনো পরিকল্পনা করলেই গ্রেপ্তার হতে হবে। বুধবার এমন একটি আইন পাস করেছে জান্তা। ‘প্রোটেকশন অব মাল্টিপার্টি ডেমোক্রেটিক ইলেকশন ফ্রম অবস্ট্রাকশন, ডিসরাপশন অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন’ নামের এই আইন ২৯ আগস্ট মঙ্গলবার পাস এবং কার্যকর করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মিয়ানমারে রাষ্ট্রায়ত্ত দৈনিক দ্য গ্লোবাল নিউ লাইট।
নতুন আইনটিতে উল্লেখ করা হয়েছেÑ সরকারের নির্বাচন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যে কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য, সমালোচনা, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ, সমালোচনামূলক লিফলেট বা প্রচারপত্র প্রকাশ ও বিতরণ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের নির্বাচন পরিকল্পনার উসকানিমূলক সমালোচনা বা প্রতিবাদ করেন, সে ক্ষেত্রে তার শাস্তি হবে সর্বনি¤œ তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাবাস। কোনো সংগঠন, সংস্থা বা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই অপরাধের সাজা হবে সর্বনি¤œ ৫ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাবাস। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় ব্যালট পেপার ধ্বংস, ভোটার-প্রার্থী-নির্বাচন কর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা-ভাঙচুর চালানো হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সর্বোচ্চ ২০ বছরের কারাদ- ভোগ করতে হবে। নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে সহিংসতা কিংবা হত্যার ঘটনা ঘটলে অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃতুদ- প্রদান করা হবে বলেও বলা হয়েছে আইনটিতে।
গত বছর ভোটার তালিকা প্রণয়নের সময় ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষের তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশন। গৃহযুদ্ধের সময় ‘নিরাপত্তা’ না থাকায় কয়েকটি অঞ্চলে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ওই ঘটনায় নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ার আভাস মিলেছে। পাশাপাশি, নির্বাচনের সময় বিদ্রোহীদের সশস্ত্র হামলার আশঙ্কাও আছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। তবে জরুরি অবস্থার অবসান ও জান্তার বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলেও মিয়ানমারে শান্তির দেখা নেই। দেশের বড় একটি অংশ আরাকান আর্মি ও অন্য বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আছে। গৃহযুদ্ধের জেরে এখন পর্যন্ত ৩৫ লাখেরও বেশি মানুষ নিজ বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :