আয়বহির্ভূতভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িচালক (ড্রাইভার) তুলসী আড্যের বিরুদ্ধে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তার এই কোটিপতি হওয়াকে রীতিমতো ক্যারিশমা বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িচালক হওয়ার দাপটে তুলসী আড্য অন্যের সম্পত্তি দখল, অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ীদের পুশ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, সরকারি খাল ইজারা নিয়ন্ত্রণ, হাটবাজার ইজারা নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্মে জড়িয়েছেন। অবৈধ এই অর্থ দিয়ে গড়ে তুলেছেন মৎস্যঘের, স মিল, বাড়িসহ প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পত্তি। তুলসী আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা এলাকার মৃত মাধব দত্তের ছেলে। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
তুলসীর সম্পদ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বুধহাটা বাজারে দেড় কোটির টাকা দামের একতলাবিশিষ্ট মার্কেট, বাড়ির পাশে তিনতলাবিশিষ্ট ভবন, ৩০ লাখ টাকা দামের স মিল, গ্রামে দোতলা ভবন, সাতক্ষীরা শহরের রাজারবাগ এলাকায় ডুপ্লেক্স বাড়ি, মহেশ্বকাটি এলাকায় ক্রয়কৃত তিন বিঘা জমিসহ ৭০ বিঘা মৎস্যঘের।
সরেজমিনে গেলে বুধহাটা বাজারের পলাশ সরদার নামে এক ব্যবসায়ী জানান, তুলসী আড্য একসময় চাপড়া আশাশুনি সড়কে বাস চালাতেন। এর কয়েক বছর পরে বাগিয়ে নেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িচালকের পদ। কয়েক বছর যেতে না যেতেই নির্বাহী কর্মকর্তার দাপটে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তুলসী। দরিদ্র মানুষের জমি থেকে শুরু করে সরকারি সম্পত্তি দখলের মহাযজ্ঞে নামেন। ড্রাইভার হওয়ার কয়েক বছরের মাথায় ১৯৯৪ সালে শেতপুর মৌজায় ৪৯৭ দাগে সাড়ে ১০ বিঘা জমি কেনেন তুলসী। এরপর ২০১৩ সালে একই জমি কাগজ জাল করে ১১ বিঘা হিসাবে বিক্রি করেন। এ ছাড়া বর্তমানে শেতপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে উপ্তি দেবনাথ ও শ্রী দেবনাথের ৫ শতক ও ৩ শতক জমি জোরপূর্বক দখল করে রেখেছেন তিনি।
তিনি আরও জানান, তুলসী মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অবৈধ এসব অর্থ দিয়ে কিনেছেন বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি। এর মধ্যে রয়েছে বুধহাটা বাজারের পাশে সাতক্ষীরার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বসির আহমেদ সাহেবের কাছ থেকে কেনা দেড় কোটি টাকা দামের তিনতলা ভবন, ৩০ লাখ টাকা দামের স মিল, বুধহাটা বাজারে দেড় কোটি টাকা দামের একতলা মার্কেট, শেতপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে কোটি টাকা দামের এক একর জমি, মহেশ্বকাটি এলাকায় ৭০ বিঘা মাছের ঘের। এ ছাড়া ভারতে তার বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি আছে বলে জানান তিনি।
শেতপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক লেলিন সরদার জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্কুলের মাঠের ২৫ শতক জমি জোরপূর্বক দখল করে নেন ড্রাইভার তুলসী। তৎকালীন বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে কোনো ফল পাওয়া যায়নি। গেল ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার সহযোগিতায় স্কুলের সম্পত্তি ফিরে পান তারা।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিদ্যালয় ভবনের পাশে ছেলেমেয়েদের জন্য খেলার মাঠ থাকলেও তুলসীর মাটি ভরাট করার কারণে জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত রয়েছে বিদ্যালয়। এর ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই বিদ্যালয়ের ভবনের পাশে পানি জমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
বুধহাটা এলাকার শ্রীদেবনাথ জানান, তুলসী আড্য ২০ বছর ধরে তার ৮ শতক জমি দখল করে রেখেছেন। জমিতে যেতে গেলে তাকে নানা রকম মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন কয়েক বছর ধরে। বর্তমানে তিনি সম্পত্তি ফিরে পেতে সাতক্ষীরা আদালতে একটি মামলা করেছেন, যা চলমান।
নাম না জানানোর শর্তে মহেশ্বকটি এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, এই এলাকায় বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছেন, তারা চিংড়ি মাছে অপদ্রব্য পুশ করেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ড্রাইভার তুলসী ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে বিভিন্ন মৎস্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা টাকা চাঁদা তোলেন। দাবিকৃত চাঁদা না দিলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ভুল বুঝিয়ে সেখানে অভিযান পরিচালনা করেন।
মহেশ্বকাটি এলাকার গৌর মন্ডল নামে এক ঘের মালিক জানান, তার মৎস্যঘেরের পাশে ৬০-৭০ বিঘা ঘের রয়েছে তুলসী আড্যের। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ড্রাইভার হওয়ার সুবাদে তিনি জমির মালিকদের ঠিকমতো হারি না দিয়ে দিনের পর দিন ঘের করে খাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে কথা বললে পড়তে হয় মামলার রোষানলে। এ জন্য সামনে প্রতিবাদ করতে সাহস পান না কেউ।
অভিযোগ অস্বীকার করে তুলসী আড্য বলেন, ‘আমি সব সম্পত্তি তিলে তিলে সৎভাবে বানিয়েছি। বর্তমানে আমার ছেলে আমার মতো ড্রাইভার হিসেবে সরকারি চাকরি করছে।’ বিপুল সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে নিজেকে সৎ দাবি করে তুলসী বলেন, ‘আমার ইনকামের বহু খাত আছে।’ তবে কীভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেন, তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। তিনি জানান, জেলা শহরের বাড়িটি তার মেয়েজামাইয়ের নামে দিয়েছেন এবং তিনি ৭০ বিঘা ঘের অস্বীকার করে মাত্র ১০ বিঘা ঘের এবং ভারতে তার কোনো বাড়ি নেই বলে জানান। বুধহাটা বাজারে তার বিশাল মার্কেটে স মিলের কথা স্বীকার করেন তিনি।
আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় বলেন, ‘তুলসী আড্য অবসরে গেছে। বর্তমানে ড্রাইভার না থাকায় তুলসী দুই বছরের চুক্তিতে মাস্টাররোলে কর্মরত রয়েছে। তুলসী যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অর্জন করেছে, তা আমার জানা নেই। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :