জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে খুলনার ছয়টি আসনে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। বিএনপিতে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থী মাঠে কাজ শুরু করেছেন। অন্যদিকে, পুরো জেলায় চমক দেখানোর লক্ষ্য নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াতসহ সম্ভাব্য ইসলামি জোট। এরই মধ্যে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করে প্রচারণা শুরু করেছে। অন্যদিকে ছয়টি আসনেই প্রার্থী ঘোষণা করেছে খেলাফত মজলিস। এ ছাড়া এনসিপির একাধিক প্রার্থীর গুঞ্জন রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা-১ (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) :
দাকোপ-বটিয়াঘাটা উপজেলা নিয়ে খুলনা-১ আসনে বিগত ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন আমীর এজাজ খান। অনেকে মনে করছেন আগামী নির্বাচনে তাকেই এখানে বিএনপির প্রার্থী করা হতে পারে। এর আগে তিনি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক থাকলেও গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর জেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে মধ্য ডিসেম্বরে মনিরুজ্জামান মন্টুকে আহ্বায়ক এবং আবু হোসেন বাবুকে সদস্যসচিব করে আংশিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে তার স্থান না থাকলেও সম্প্রতি তিনি সক্রিয় হয়ে উঠেছেন দলীয় কর্মকা-ে। এজাজ খানের পাশাপাশি একই আসনে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী জিয়াউর রহমান পাপুল। শুভেচ্ছা জানিয়ে টানানো ব্যানারে তিনি নিজেকে এই আসনের ধানের শীষের কান্ডারি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি। এ ছাড়া এই আসনে বিএনপির প্রার্থী তালিকায় শোনা যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা পার্থ দেব মন্ডল, জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি এস এম শামীম কবির ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আহ্বায়ক তৈয়েবুর রহমানের নাম। এই আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতের আমির শেখ আবু ইউসুফ আর ইসলামী আন্দোলনের একক প্রার্থী মাওলানা আবু সাঈদ। আর খেলাফত মজলিসের একক প্রার্থী মাওলানা এমদাদুল হক।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, খুলনা-২ আসনকে ভিভিআইপি আসন বলা হয়ে থাকে। কারণ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এই আসন থেকে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেছিলেন। এ ছাড়া সাবেক স্পিকার রাজ্জাক আলী এই আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অথবা তার স্ত্রী জোবাইদা রহমান এবার এই আসনে প্রার্থী হতে যাচ্ছেন।
খুলনা-২ (খুলনা সদর ও সোনাডাঙ্গা) :
খুলনা সদর ও সোনাডাঙ্গা থানা নিয়ে গঠিত খুলনা-২ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। পতিত আওয়ামী লীগ আমলে এই আসন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর দখলে ছিল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এবার আসনটি ফিরে পেতে চাইছে বিএনপি। এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু বিএনপিতে না থাকলেও কর্মকা- থেকে পিছিয়ে নেই। নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘আমি নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। আমার দল চাইছে ক্লিন ইমেজের মানুষ, জনপ্রিয় ব্যক্তি।
আন্দোলন-সংগ্রামে জেল-জুলুম, নির্যাতনের শিকার এমন মানুষকে মূল্যায়ন করবে। এ ক্ষেত্রে আমি একজন পরীক্ষিত প্রার্থী।’ এ ছাড়া এই আসনে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিনও নিজেকে প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। শফিকুল আলম তুহিন বলেন, ‘এ আসনের ১৬টি ওয়ার্ডের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর শহরের মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য দিন-রাত কাজ করেছি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ সব ব্যবসায়ীকে নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। খুলনার মানুষ আমাদের প্রতি আস্থাশীল। আমি ৪৩ বছর ধরে রাজনীতি করি। এ শহরের অলিগলি, রাস্তাঘাটসহ সব মানুষকে আমি চিনি। এই শহরের সবকিছুর সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক আছে। শহরের প্রতিটি ভালো কাজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রয়েছে।’
খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘দল থেকে যে আসনে প্রার্থী করবে, সেই আসন থেকেই নির্বাচন করার ইচ্ছা পোষণ করছি।’ এ ছাড়া তিনি আরও বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।’ এখানে জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে এরই মধ্যে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছেন নগর জামায়াতের সেক্রেটারি, মহানগর ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও কেসিসি ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল। অ্যাডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল বলেন, ‘নির্বাচনে দুই ধরনের কাজ করতে হয়। নমিনেশন দেওয়ার পরে এক ধরনের কাজ, তপশিল ঘোষণা করার পরে আরেক ধরনের কাজ।
এখন আমাদের মূল লক্ষ্য হলো গণসংযোগ করা। প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে আমরা নির্বাচনি গণসংযোগ করছি। মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে চলা, সাংগঠনিক কার্যক্রম মজবুত করা এবং সংগঠনকে গতিশীল করছি। এ জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছি।’ ইসলামী আন্দোলনের ঘোষিত প্রার্থী হিসেবে মুফতি আমান উল্লাহ বেশ আগে থেকেই নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। আর খেলাফত মজলিসের প্রার্থী রয়েছেন অ্যাডভোকেট মো. শহীদুল ইসলাম। নির্বাচনের মাঠে এ আসনে বিএনপি ও জামায়াত সরব থাকলেও এনসিপির কোনো নির্বাচনি তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
খুলনা-৩ (খালিশপুর, দৌলতপুর ও আড়ংঘাটা-খানজাহান আলী) :
খালিশপুর, দৌলতপুর ও আড়ংঘাটা-খানজাহান আলী থানার একাংশ নিয়ে গঠিত খুলনা-৩ আসনে বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে এখন পর্যন্ত রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল। সাবেক ছাত্রনেতা অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলামও এই আসন থেকে প্রার্থী হতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। এখানে জামায়াতের একক প্রার্থী নগর জামায়াতের আমির ও নগর ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান। এ ছাড়া এনসিপির প্রার্থী হিসেবে এই আসনে নির্বাচন করতে পারেন নগর বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ আরিফুর রহমান মিঠু। আনুষ্ঠানিকভাবে এমন ঘোষণা না এলেও সাম্প্রতিক কিছু কর্মকা-ে এটি অনেকটা স্পষ্ট। সম্প্রতি খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া সাবেক এমপি আবদুল গফফার বিশ্বাসও এখানে কোনো দলের প্রার্থী হতে পারেন।
ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির হাফেজ মাওলানা অধ্যক্ষ আবদুল আউয়াল কৌশলে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির হাফেজ মাওলানা আবদুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। নির্বাচনের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি রয়েছে। তবে কেন্দ্র থেকে এখনো মাঠে নামার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। নির্দেশ পেলেই মাঠে নেমে পড়ব।’ এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের প্রার্থী রয়েছেন এফ এম হারুন-অর-রশীদ।
খুলনা-৪ (রূপসা-দীঘলিয়া-তেরখাদা) :
রূপসা-দীঘলিয়া-তেরখাদা নিয়ে গঠিত খুলনা-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কর্মকা- চালিয়ে আসছেন দলের কেন্দ্রীয় তথ্যবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রদল নেতা আজিজুল বারী হেলাল। মাঠে তৎপর বিএনপির সাবেক তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক শরীফ শাহ কামাল তাজও। এই আসনে বিএনপির প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পারভেজ মল্লিকও। তিনি সম্প্রতি খুলনাসহ নির্বাচনি এলাকায় বিভিন্ন কর্মকা-ে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে শুরু করেছেন। এখানে জামায়াতের প্রার্থী জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যক্ষ মাওলানা কবিরুল ইসলাম এবং ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব হাফেজ মাওলানা অধ্যক্ষ ইউনুস আহমদ। খেলাফত মজলিসের একক প্রার্থী রয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন। এনসিপি নেতা কদরুল হাসান বলেন, দলের নিবন্ধন না পাওয়া পর্যন্ত কে কোন আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হবেন, এখনো কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত হয়নি।
খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) :
ডুমুরিয়া-ফুলতলা নিয়ে গঠিত খুলনা-৫ আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী সাবেক এমপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। সম্প্রতি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রচার করে দলীয় কর্মকা-ে অংশ নিচ্ছেন খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি ও বিসিবির সাবেক পরিচালক আলী আসগর লবি। এই আসনে প্রার্থী হতে চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী টিকু রহমান ও শফি মোহাম্মদ খান। এর বাইরেও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে অধ্যাপক ডা. গাজী আবদুল হক ও সাবেক যুবদল নেতা মোল্লা মোশাররফ হোসেন মফিজের নাম। এই আসনে ইসলামী আন্দোলনের একক প্রার্থী দলের ডুমুরিয়া উপজেলা শাখার সহসভাপতি মুফতি আবদুস সালাম। তবে এখানে তার পক্ষে কোনো প্রচারণা নেই বললেই চলে। খেলাফত মজলিসের একক প্রার্থী রয়েছেন মুফতি আ. জব্বার আজমী।
খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) :
কয়রা-পাইকগাছা নিয়ে গঠিত খুলনা-৬ আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন তৎপরতা চালাচ্ছেন দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও খুলনা অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। এখানে বিএনপির প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সহসভাপতি আমিরুল ইসলাম কাগজী ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মন্টু। আলোচনায় রয়েছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোমরেজুল ইসলাম, বিএনপি নেতা আবদুল মজিদ ও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা রফিকুল ইসলামও। এ ছাড়া বিএনপির প্রার্থী প্রত্যাশায় পাইকগাছায় বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসসের চেয়ারম্যান আনোয়ার আলদীন। আনোয়ার আলদীন বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এ অঞ্চলের বহু মানুষ নানা ধরনের দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু অনেকেই অর্থাভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না। তাই আমরা বিনা মূল্যে চক্ষু ক্যাম্পের আয়োজন করি।
তিনি আরও বলেন, ৩০ বছর রাজনৈতিক দলীয় দুর্বৃত্তদের দখলে থাকা একটি ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সরকারি নাছিরপুর খাল দখলমুক্ত করে স্থানীয় সর্বসাধারণ জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামী আন্দোলনের জেলা সেক্রেটারি হাফেজ আসাদুল্লাহ গালিব এ আসনে দলের ঘোষিত প্রার্থী। জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেন, দলের সিদ্ধান্তেই নেতারা প্রার্থী হয়েছেন। সব আসনেই কর্মীরা তাদের পক্ষে কাজ করছেন। খেলাফত মজলিসের একক প্রার্থী রয়েছেন মাওলানা সোলাইমান হোসেন নোমানী।