ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর, ২০২৫

বালুমহাল দ্বন্দ্বে খুন  হন আবদুল হাকিম

জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২৫, ১২:২৭ এএম
  • দলীয় পদ না থাকলেও আবদুল হাকিম বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী
  • রাজনৈতিক কারণে নয়, বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ নিতে এ হত্যাকা- ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সূত্র
  • হয়নি মামলা। সন্দেহভাজন চারজন আটক

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানালেও স্থানীয় সূত্রের দাবি, চট্টগ্রামের রাউজানে বালুমহালের আধিপত্যে প্রতিপক্ষ একটি গ্রুপের ভাড়া করা আততায়ীর গুলিতে নিহত হন বিএনপি কর্মী আবদুল হাকিম। যদিও হত্যাকা-ের ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হলেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মামলা করতে থানায় আসেনি পরিবারের কেউ।

আবদুল হাকিমকে কারা এবং কোন কারণে হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়ে পুলিশ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকা-ের পর অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে সক্রিয়ভাবে মাঠে কাজ করছে র‌্যাব ও পুলিশ। এরই মধ্যে সন্দেহাভাজন চারজনকে আটক করেছে হাটহাজারী থানা পুলিশ। হত্যাকা-ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছয়জন পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। এদিকে নিহত আবদুল হাকিম বিএনপি নেতা নন বলে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করলেও রাউজানের একাধিক নেতার দাবি, আবদুল হাকিম বিএনপিতে সক্রিয় ছিলেন। আবদুল হাকিমকে রাউজান বিএনপির সক্রিয় কর্মী দাবি করে বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস কাদের চৌধুরী বলেছেন, ‘আবদুল হাকিম রাউজান বিএনপির সক্রিয় একজন কর্মী। দীর্ঘদিন ধরে আমার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন।’ 

হত্যাকা-ের ক্লু সম্পর্কে জেলা পুলিশ সরাসরি কিছু না বললেও বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে মাঠে কাজ করছে বলে জানিয়েছে সূত্র। এর মধ্যে রয়েছে গিয়াস কাদের চৌধুরীর সঙ্গে একই দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খন্দকার গোলাম আকবরের রাজনৈতিক আধিপত্য দ্বন্দ্ব, গিয়াস কাদের চৌধুরী সমর্থক একাধিক গ্রুপিং দ্বন্দ্ব, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ফজলুল কাদের চৌধুরীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব এবং বালুমহালের দখল রাজত্ব। 

গত মঙ্গলবার বিকেলে রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের নিজ গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের বাসায় যাচ্ছিলেন আবদুল হাকিম। পথে খামারবাড়ি হা-মীম অ্যাগ্রোয় বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটান। এরপর ব্যক্তিগত গাড়িতে করে কাপ্তাই সড়ক হয়ে চট্টগ্রাম নগরের দিকে আসছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন শুক্কুর নামের এক ব্যক্তি এবং গাড়িচালক ইসমাইল। গাড়িটি মদুনাঘাটসংলগ্ন পানি শোধনাগার এলাকায় পৌঁছালে গুলি করতে থাকে তিন মোটরসাইকেলে আসা ছয় আততায়ী। এ সময় দুজন গুলিবিদ্ধ হন। এর মধ্যে আবদুল হাকিম মারা যান হাসপাতালে নেওয়ার পথে। এবং শরীরে গুলি লাগে চালক ইসমাইলের। অক্ষত ছিলেন শুক্কর। 

তথ্যসূত্র বলছে, খামারবাড়ি হা-মীম অ্যাগ্রো থেকে বের হওয়ার পর আবদুল হাকিমের গাড়ির পিছু নেয় তিন মোটরসাইকেলে ছয় আততায়ী! পথে বেশ কয়েকবার গাড়ি থামাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টাও করেছিল তারা। পানি শোধনাগারসংলগ্ন রাস্তায় পেছেন থেকে দুটি মোটরসাইকেল এসে সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে গাড়ি থামাতে বাধ্য হন ইসমাইল। গাড়ি থামা মাত্রই এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে তারা। 

হত্যাকা-ের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আনুষ্ঠানিক কিছু না বললেও পুলিশ ও র‌্যাবের একাধিক কর্মকর্তার দাবি, রাজনৈতিক কারণে নয় বরং বালুমহালের রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গিয়াস কাদের চৌধুরী সমর্থক গ্রুপের মধ্যে অন্তকোন্দলের কারণে পেশাদার কিলারদের দিয়ে আবদুল হাকিম হত্যাকা- ঘটনা ঘটানো হয়। 

নিহত আবদুল হাকিম রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের পাঁচখাইন গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাউজানে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী। আবদুল হাকিম দলীয় কোনো পদে না থাকলেও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছত্রছায়ায় দখল রাজত্বের একছত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। 

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সান্তু বলেন, ঘটনার পর থেকে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে মাঠে কাজ শুরু করেছে জেলা ও থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি ইউনিট। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এরই মধ্যে চারজনকে আটক করা হয়েছে। 

নিহত আবদুল হাকিমের শরীরে ১০টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে এসব আঘাতের চিহ্ন ওঠে এসেছে। এসব আঘাত বুলেটের কি না, তা নিশ্চিত নন পুলিশ। তবে পুলিশের ধারণা এলোপাতাড়ি গুলি করার কারণে গাড়ির গ্লাস ভেঙে শরীরের আঘাতগুলো সৃষ্টি হতে পারে।

নিহত আব্দুল হাকিমের ভাই মুহাম্মদ পারভেজ বলেন, ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কারো শত্রুতা ছিল না। তিনি গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারী। কী কারণে তাকে হত্যা করা হলো জানি না। 

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে অস্থির হয়ে রয়েছে চট্টগ্রামের রাউজান। একের পর এক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেই চলেছে এ জনপদে। চাঁদাবাজি, মাটি-বালু ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কারণে গত বছর ২৮ আগস্ট থেকে সর্বশেষ ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১৪ জন নিহত হয়েছেন রাউজানে। আহত হয়েছেন ৫০ জনের অধিক। বেশির ভাগ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ঘাতক পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে।