গ্রামবাংলার মাঠ, বাগান ও নদীপাড়ের ঐতিহ্য ছিল তাল এবং নারকেলগাছের ডালে বাবুই পাখির নিপুণ কারুকার্যপূর্ণ বাসা। এই ছোট পাখি শুধু প্রকৃতির শোভা বাড়াত না, বরং গ্রামের মানুষের মন ও কল্পনাশক্তিকেও সমৃদ্ধ করত। তবে আজ সেই বাবুই পাখি ও তার শৈল্পিক বাসা ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, নতুন বনায়ন এবং খাদ্যের অভাবের কারণে বাবুই পাখির সংখ্যা ক্রমেই কমছে। এ ছাড়া নির্বিচারে তাল, নারকেল ও খেজুরগাছ নিধনও তাদের জন্য বড় হুমকি তৈরি করেছে। একসময় গ্রামের পথচারী, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ও স্থানীয় কৃষকরা বাবুই পাখির বাসা দেখে মুগ্ধ হতো। বাসাটি নিখুঁত কারুশিল্পের মতো, বাবুই পাখি তাতে বসবাস, ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটানো এবং খাদ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষভাবে গঠন করত।
বাবুই পাখি বাসা তৈরিতে তালপাতা ও নারকেলপাতাকে প্রধানভাবে ব্যবহার করত। পুরুষ বাবুই পাখি বাসা নির্মাণ শেষ হলে সঙ্গী পছন্দের জন্য নিজেকে আকর্ষণীয় করতে খাল, বিল ও ডোবার পানিতে গোসল সেরে গাছের ডালে নেচে বেড়াত। রাতের বেলায় ঘরের ভেতরে জোনাকি পোকা রেখে আলো জোগানো তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এসব আচরণ প্রমাণ করে, বাবুই পাখি শুধু প্রকৃতির একটি প্রাণী নয়, বরং এক ধরনের শিল্পীও বটে।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানাচ্ছেন, বাবুই পাখি কৃষকের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে থাকে, যা ফসলের জন্য উপকারী। তবে বর্তমানে বাসস্থান সংকট ও খাদ্যের অভাবে এই পাখি খুব বেশি দেখা যায় না। গ্রামের রাস্তায় তাদের কিচিরমিচির শব্দও শোনা যায় না। প্রজনন ঋতুতে একসময় গ্রামের পরিবেশ ভরে যেত তাদের কিচিরমিচির কোলাহলে, যা এখন এক বিরল স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিবেশবিদরা মনে করাচ্ছেন, এই পরিস্থিতি শুধু বাবুই পাখির জন্যই হুমকি নয়। দোয়েল, চড়ুই, শালিক, চিল, কাক, কোকিলসহ অন্য দেশীয় পাখিরাও বিলুপ্তির পথে। তাই এখনই পদক্ষেপ না নিলে একদিন গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে এসব পাখি চিরতরে হারিয়ে যাবে।
আগৈলঝাড়া উপজেলার সহকারী বন কর্মকর্তা কালিপদ পুইস্তা বলেন, ‘আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাবুই পাখি ও তাদের শৈল্পিক বাসা সংরক্ষণ করতে হবে। সরকার, পরিবেশবিদ ও সাধারণ মানুষকে একসাথে কাজ করতে হবে যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত হয়।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘আমরা সবাইকে তাল, নারিকেল ও খেজুরগাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে উদ্বুদ্ধ করছি। তালগাছ শুধু বাবুই পাখির জন্য নয়, বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতেও সহায়ক। খেজুরগাছের মাধ্যমে মানুষ রস ও গুড়ের চাহিদা পূরণ করতে পারবে। পাশাপাশি, পাখিরা তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান পাবে এবং আমাদের গ্রামীণ পরিবেশকে শৃঙ্খলিত ও জীবন্ত রাখবে।’
পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়ানো গেলে শুধু বাবুই পাখিই নয়, দেশের অন্যান্য দেশীয় পাখিও বাঁচানো সম্ভব। তাই সময় এখনই সচেতন হয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার। না হলে একদিন আমাদের গ্রামবাংলার তাল-নারকেল-খেজুরগাছের ডালে কারুকার্যময় বাবুই পাখির বাসা শুধু স্মৃতিতেই বেঁচে থাকবে।

