জোহরান মামদানি। নিউইয়র্ক সিটির নবনির্বাচিত মেয়র। সদ্য ৩৪-এ পা দিয়েছেন। ভারতীয় পিতা-মাতার সন্তান। গায়ের রং বাদামি, ধর্মে মুসলিম এবং রাজনীতিতে ঘোর বামপন্থি। ঠিক এমন একজন রাজনীতিবিদ, যেমনটা বামপন্থিদের অনেকেই বহু বছর ধরে খুঁজছিলেন। সেই জোহরান মামদানি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের চোখে যিনি শুধু বহিরাগত নন, সম্ভবত একজন অবৈধ অভিবাসী। নিউইয়র্ক সিটিতে তিনিই তরুণতম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এটা এমন এক ঘটনা, যা রূপকথাকেও হার মানায়।
জোহরান মামদানি নানা দিক থেকেই বেশ উল্লেখযোগ্য। ১৮৯২ সালের পর তিনি শহরের সর্বকনিষ্ঠ মেয়র। এ ছাড়া আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম মুসলিম মেয়রও তিনি। গত বছর সামান্য অর্থ এবং পরিচিতি নিয়ে কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক দলীয় সমর্থন ছাড়াই এই প্রতিযোগিতার দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন জোহরান মামদানি, যা সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো ও রিপাবলিকান মনোনীত প্রার্থী কার্টিস সিলওয়ার বিরুদ্ধে অসাধারণ জয় এনে দিয়েছে তাকে। তিনি তরুণ ও ক্যারিশম্যাটিক; নিজের প্রজন্মের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একটা স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে তার। তার জাতিগত পরিচয় দলের ভিত্তির বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে। তিনি কোনো রাজনৈতিক লড়াই থেকে পিছপা না হয়ে গর্বের সাথে বামপন্থিদের উদ্দেশ্যগুলোকে সমর্থন করেছেনÑ যেমন বিনা মূল্যে শিশু যতেœর ব্যবস্থা, গণপরিবহন সুবিধা সম্প্রসারণ এবং মুক্তবাজার ব্যবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ।
নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি গত বুধবার ঘোষণা করেছেন, তার প্রশাসন গঠনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নতুন প্রশাসন গঠনে যে ট্রানজিশন টিম গঠন করা হয়েছে, তাতে পাঁচজনই নারী। আগামী ১ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার দিন থেকেই কাজ শুরু করার অঙ্গীকার করে তিনি বলেন, তার নেতৃত্বে গড়ে উঠবে এক দক্ষ ও সহানুভূতিশীল সিটি হল, যা এই প্রচারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সক্ষম হবে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, ৩৪ বছর বয়সি এই নবনির্বাচিত মেয়র কুইন্সে সংবাদ সম্মেলনে পুরোপুরি নারী নেতৃত্বে গঠিত ট্রানজিশন টিম ঘোষণা করেন। এই টিমের নির্বাহী পরিচালক ইলানা লিওপোল্ড। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকছেন সাবেক ফার্স্ট ডেপুটি মেয়র মারিয়া তোরেস-স্প্রিংগার, ফেডারেল ট্রেড কমিশনের (এফটিসি) সাবেক চেয়ারম্যান লিনা খান, ইউনাইটেড ওয়ের প্রেসিডেন্ট ও সিইও গ্রেস বোনিলা এবং সাবেক ডেপুটি মেয়র ফর হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস মেলানি হার্টজগ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের নির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানিকে সহায়তা করার জন্য তিনি উন্মুক্ত বলে জানিয়েছেন। একই সঙ্গে সতর্ক করে তিনি বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী’ মামদানিকে সফল হওয়ার জন্য ওয়াশিংটনের প্রতি ‘সম্মানজনক’ হতে হবে। বুধবার এমন মন্তব্য করেন ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন সময়ে মন্তব্যটি করলেন যখন মামদানি যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরের প্রথম মুসলিম এবং প্রথম দক্ষিণ এশীয় মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তার ট্রানজিশন টিম ঘোষণা করেছেন। মতাদর্শে ভিন্নতা থাকায় আগে থেকেই ট্রাম্প ও মামদানির মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বিজয়ের পরপরই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মামদানি প্রতিক্রিয়া জানান। এরপর পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানান মার্কিন প্রেসিডেন্টও। মেয়র নির্বাচিতদের মন্তব্যকে ‘বিপজ্জনক বক্তব্য’ হিসেবেও বর্ণনা করেন তিনি। ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ‘তাকে ওয়াশিংটনের প্রতি কিছুটা শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, কারণ যদি তিনি তা না করেন, তাহলে তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান র্যান্ডি ফাইন ও অ্যান্ডি ওগলস বিচার বিভাগকে আহ্বান জানান মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল করতে। টেক্সাসের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান চিপ রয় নির্বাচনের আগে লেখেন, মামদানি ‘আধুনিক ডেমোক্র্যাট দলের প্রতীক’ এবং তার নেতৃত্বে ‘একটি ইসলামি সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ ঘটছে। সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব অর্গানাইজড হেট-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বরে তুলনায় অক্টোবরে মামদানিকে নিয়ে ইসলামবিদ্বেষী পোস্ট বেড়েছে ৪৫০ শতাংশ। এক মাসে ১৭ হাজার অ্যাকাউন্ট থেকে ৩৬ হাজার পোস্ট হয়েছে, যা ৭৩ লাখের বেশি লাইক পেয়েছে।
তবে মামদানি আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘আমরা গত এক বছর যে নীতিগুলোর কথা বলেছি, আমি নিশ্চিত সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারব। রাজনীতি যাই হোক, নিউইয়র্কবাসীর সমস্যা একটাইÑ আমরা সবাই একই সংকটে ভুগছি।’ মামদানির প্রগতিশীল নীতিগুলোর মধ্যে আছেÑ অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া স্থির করা, বাসে বিনা মূল্যে যাতায়াত, সর্বজনীন শিশুসেবা, শহর পরিচালিত মুদি দোকান ও ধনীদের ওপর বাড়তি কর। তার প্রচার তহবিলে ২০ মিলিয়ন ডলার এসেছে সাধারণ দাতাদের কাছ থেকে, গড়ে প্রতি অনুদান প্রায় ৮০ ডলার। মামদানির দপ্তর জানিয়েছে, শিগগিরই তারা ডেপুটি মেয়র ও বিভিন্ন দপ্তরের কমিশনারদের নাম ঘোষণা করবেন। তিনি বলেন, ‘কিছু নাম পরিচিত হবে, কিছু নতুন। কিন্তু সবাই এক লক্ষ্যেই ঐক্যবদ্ধÑ পুরোনো সমস্যার নতুন সমাধান।’ মামদানি বলেন, ‘১ জানুয়ারি যখন আমরা নতুন প্রশাসনের শপথ নেব, নিউইয়র্কবাসী তখন শুধু নতুন মেয়র নয়, নতুন এক যুগকেও স্বাগত জানাবেÑ যেখানে প্রত্যেকে নিজের অংশীদারত্ব অনুভব করবে, আর এই শহরের সাফল্য হবে আমাদের সবার।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন