পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ায় সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন শহিদ সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনেরা। পাশাপাশি সম্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করার পাশাপাশি দোষী ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশ এবং তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। গত রোববার জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন বিডিআর হত্যাকা-ের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় আংশিক তথ্য প্রকাশ করে কমিশন। সেখানে আলোচনায় আসে ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির নাম ও আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত।
গতকাল সোমবার সকালে শহিদ সেনা সদস্যদের পরিবার গণমাধ্যমের কাছে প্রতিক্রিয়া জানায়। রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে ‘বিডিআর তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশে শহিদ পরিবারের মতপ্রকাশ’ শিরোনামে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানেই নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনেরা এসব কথা বলেন। তবে পুরো প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ায় তারা বিস্তারিত মন্তব্য থেকে বিরত থাকেন।
সাবেক বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত ও ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে পিলখানা হত্যাকা- ঘটিয়েছেন শেখ হাসিনা। হত্যাকা-ের মূল মেসেজ ছিল কোনো সেনা কর্মকর্তা যদি ভারতবিরোধী থাকে তা হলে তাদের পরিণতি পিলখানার মতো হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ হত্যাকা-ের বিচার হতেই হবে, আমরা ছাড়ব না। রিপোর্টে যাদের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করতে হবে সরকারকে। মীরজাফরদের বিচার করতে হবে, না হলে আরও একটা পিলখানা হত্যাকা- ঘটাতে পারে।’
সংবাদ সম্মেলনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমান খানের মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা বলেন, “কমিশনের প্রধান জেনারেল ফজলুর রহমান বলেছেন, প্রতিবেদনটি ‘ক্ল্যাসিফায়েড’ নয় এবং পরে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। শহিদ পরিবারের আহ্বান, প্রক্রিয়াটিতে বিলম্ব না করে দ্রুত বিচার বিভাগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ পাঠানো, সম্ভাব্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা, যেমন ট্রাভেল ব্যান নিশ্চিত করা এবং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা।”
তিনি আরও বলেন, ‘৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের প্রাণহানি শুধুই একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়, এটি জাতিগত বিপর্যয়। করদাতাদের অর্থে সংগঠিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে সার্বভৌমত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করার যে ষড়যন্ত্র ঘটেছে, তার সত্য জানার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের আছে।’
পিলখানায় হত্যার শিকার কর্নেল কুদরত ইলাহীর সন্তান আইনজীবী সাকিব রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘কমিশন খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, কিছু কিছু নাম, যেগুলো তারা পেয়েছেন, তারা এই মুহূর্তে সেগুলোই প্রকাশ করতে পারবেন না। সেটার যৌক্তিকতাটা আমরা কিছুটা বুঝি। তবে আমার মনে হয় না যে এটাকে অজুহাত দেখিয়ে অনেক দিন ধরে সেই নাম প্রকাশ হবে না। সেটা কোনোভাবে আমরা মেনে নেব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব সব ব্যক্তিÑ সামরিক ও বেসামরিক সবার বিরুদ্ধে যেন অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করা হয় এবং তারা যেন অ্যারেস্ট হয়। যদি রিপোর্টটা পাবলিক না হয়, আমরা আশঙ্কা করি, যেসব মানুষের নাম এসেছে, তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।’
পিলখানায় হত্যার শিকার কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, ‘এই রিপোর্টের পরে আমরা শুধু শহিদ পরিবার নয়, এ দেশের সব জনগণ এখন একেবারে সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবে যে এই হত্যাকা- কারা ঘটিয়েছে। এটা এই সময়ের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন। এ দেশের মানুষ একেবারে সুনির্দিষ্ট করে বলবে যে আওয়ামী লীগ এই হত্যাকা- করেছে। শেখ হাসিনা এই হত্যাকা- করেছে। ভারত এর সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন আমাদের আর কোনো ভীতিতে থাকতে হবে না। আর আমি সরকারের কাছে দাবি করব, এই যে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে, এটি যেন দ্রুত সময়ে ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়।’
হত্যার শিকার মেজর কাজী মোসাদ্দেক হোসেনের মেয়ে কাজী নাজিয়া তাবাসসুম বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছর হত্যার শিকার সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারগুলো অবহেলা, ভান করা সহমর্মিতা আর মিথ্যা আশ^াসই পেয়েছে। এখনো পরিবারগুলো পুরো আস্থা পায় না, কারা সত্যিকার অর্থে তাদের পাশে আছে।’
হত্যার শিকার কর্নেল মুজিবুল হকের ছেলে মুহিব হক বলেন, ‘ডিফেমেশন শুধু আইনি শব্দ না, এটা একটা অস্ত্র। এই অস্ত্রটা ব্যবহার করা হয়েছে আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে, ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে।’
উল্লেখ্য, রোববার জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বিডিআর বিদ্রোহের নামে সংঘটিত বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের বিষয় তদন্তের জন্য গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান ও অন্য সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেন। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেনÑ মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাইদুর রহমান বীরপ্রতীক, মুন্সী আলাউদ্দিন আল আজাদ যুগ্মসচিব (অব.), ড. এম. আকবর আলী ডিআইজি (অব.), ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরীফুল ইসলাম, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ খান চন্দন।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন