প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অসংক্রামক রোগ হলে মানুষ উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়ের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে অতি উচ্চমূল্যে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হয়। দেশের বিপুল অঙ্কের টাকা চলে যায় বিদেশে এসব রোগের চিকিৎসাব্যয় মেটাতে। তাই অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা যেমন উন্নত হওয়া জরুরি, তেমনি রোগগুলো যেন কম হয় অথবা না হয়, সে জন্য উপযুক্ত জনসচেতনতাসহ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা বাড়াতে ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা এ কথাগুলো বলেন। গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এই অনুষ্ঠান হয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, স্বাস্থ্য খাতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু নিয়ে আমরা সবাই আজ একত্র হয়েছি। গুরুত্বপূর্ণ বলছি এ কারণে যে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে দক্ষ ও কর্মক্ষম মানবসম্পদ দরকার। দক্ষ ও কর্মক্ষম মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারলে ব্যক্তিগত জীবন থেকে জাতীয় উন্নয়নÑ কোনোটাই যথাযথভাবে করা যাবে না। তাই যেকোনো পরিস্থিতি এবং যত চ্যালেঞ্জিংই হোক না কেন, আমাদের সুস্থ-সবল প্রজন্ম গড়ে তুলতেই হবে। এ জন্য সরকারি, বেসরকারি, সুশীল সমাজ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষÑ সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কেবল পারস্পরিক অংশীদারত্বের মাধ্যমেই এটা সম্ভব। আর সে কারণেই আজকের আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়।
তিনি বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই অসংক্রামক রোগ দিনে দিনে বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, ভৌগোলিক অবস্থান ও বিপুল জনগোষ্ঠীর ছোট এলাকায় বসবাসের প্রেক্ষাপটে এ পরিস্থিতি আরও সংকটময়। তাই এটি জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা শুধু স্বাস্থ্য খাত নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, সামাজিক নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িত।
প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর শতকরা ৭১ ভাগ ঘটে থাকে অসংক্রামক রোগের কারণে। এর মধ্যে শতকরা ৫১ ভাগ মানুষের মৃত্যু হয় ৭০ বছর বয়সের নিচে, যাকে অকালমৃত্যু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের ব্যক্তিগত চিকিৎসা ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার) ৬৯ শতাংশ, যার বেশির ভাগ অসংক্রামক রোগের জন্য ব্যয় হয়।
তিনি বলেন, অসংক্রামক রোগ হলে মানুষ উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়ের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়। কোনো ব্যক্তির ক্যানসার হলে তার পরিবারকে আর্থিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হয় এবং প্রায় ক্ষেত্রেই সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে অতি উচ্চমূল্যে চিকিৎসা নেওয়ারও প্রয়োজন হয়। দেশের বিপুল অঙ্কের টাকা চলে যায় বিদেশে এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে।
তাই অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা যেমন উন্নত হওয়া জরুরি, তেমনি রোগগুলো যেন কম হয় অথবা না হয়, সে জন্য উপযুক্ত জনসচেতনতাসহ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। এ জন্য সব মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা দরকার। খাদ্য, কৃষি, শিক্ষা, ক্রীড়া, স্থানীয় সরকার, গণপূর্তÑ এমন প্রতিটি খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রতিটি খাত থেকে দরকার সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও নিবিড় উদ্যোগ। তাই এসব মন্ত্রণালয় চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রথমত জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকগুলোর বিষয়ে দেশের মানুষের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতনতা আছেÑ এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অনেকেই সচেতন থাকলেও জীবনযাপনে হয়তো সেভাবে প্রতিফলন নেই। ফলে নানামাত্রিক শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন-অগ্রগতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যেমন তরুণদের মধ্যে অনেকে একই সঙ্গে পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। আবার অতিরিক্ত ওজন নিয়ে শারীরিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতেও রয়েছেন। তামাকের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজকে আজ সচেতন করা না গেলে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচেতনতার জন্য চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে জরুরি ভিত্তিতে মানুষকে সচেতন করতে হবে। জাতীয় নীতিগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে, যেন সেগুলো স্বাস্থ্যবান্ধব হয়, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়; শিশু, কিশোর ও নারীস্বাস্থ্য যেন বিশেষ অগ্রাধিকার পায়, নাগরিক সমাজ ও যুবশক্তি যেন সচেতনতা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে। সুবিস্তৃত জনসচেতনতা এবং সর্বস্তরে স্বাস্থ্যবান্ধব নীতি-কৌশল গ্রহণ হতে পারে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বড় হাতিয়ার। তাই স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন ও দায়িত্বশীল নাগরিক আচরণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। এটিকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ‘যৌথ ঘোষণা’ বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি দরকার বেসরকারি উদ্যোগ। দরকার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক কারিগরি সহযোগিতা। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল প্রয়োগ করে এ-সংক্রান্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ‘যৌথ ঘোষণা’ বাস্তবায়ন সহজ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবে, স্বাক্ষরকারী মন্ত্রণালয়গুলো সহযোগিতা করবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তৃতীয়ত, যেকোনো কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিবিড় মনিটরিং ও মূল্যায়ন আবশ্যক। আবার এগুলো করতে দরকার উপযুক্ত ও দক্ষ জনবল, আর্থিক বরাদ্দ। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই দিক বিবেচনায় রাখতে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সবাই ‘যৌথ ঘোষণা’ বাস্তবায়নের কাজটি বিশেষ অগ্রাধিকারে রাখবেন, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও জনবল নিশ্চিত করবেন, যেন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় বিশেষ কোনো সীমাবদ্ধতা বা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি না হয়।
তিনি বলেন, আজকের এই ‘যৌথ ঘোষণা’ স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমরা একসঙ্গে কাজ করতে নতুন করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম। এটি শুধু একটি আয়োজনের মধ্যে যেন সীমাবদ্ধ না থাকে। এটি আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস। আমি বিশ্বাস করি, এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে। এটি হবে অগ্রগতির একটি নতুন মাইলফলক। স্বাস্থ্যসম্পর্কিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও এসডিজি-পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডাগুলো অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে অর্জনে সহায়ক হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আরও বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে, বিশেষ করে ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ সত্যিই প্রশংসনীয় ভূমিকা নিয়েছে। তিনি জেনেছেন, আজকের আয়োজনে তারা গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা করেছে। এ জন্য তিনি তাদের ধন্যবাদ জানান।