ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ, যা শুধু শারীরিক অত্যাচার নয়, নারীর মানসিক এবং সামাজিক অবস্থাকেও বিপর্যস্ত করে। তবে, আমাদের সমাজে ধর্ষণ অপরাধীদের শাস্তি অনেক সময় থাকে সামান্য বা প্রায় থাকে না। ধর্ষণের মামলা সংক্রান্ত বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতা, আইনি ফাঁকফোকর এবং অপরাধীদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের প্রভাবের কারণে অনেক সময় ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।
ধর্ষণের পর নারীরা শুধু শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন না, তাদের মানসিক অবস্থা এবং সামাজিক অবস্থানও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, ধর্ষণের শিকার নারীকে প্রথমে সম্মানহানি এবং সমাজের ঘৃণার শিকার হতে হয়। অনেক নারী বিচার পাওয়ার আগেই সমাজে নিজেদের হারিয়ে ফেলেন।
আমাদের দেশে বেশির ভাগ মেয়ে পুরুষের অবাঞ্ছিত স্পর্শ, চাহনি বা মন্তব্য প্রকাশ করার সাহস বা সুযোগ পান না। সবাইকে বলা হয়, ‘চুপ, চুপ, একদম চুপ। এ তো লজ্জার কথা। এসব প্রকাশ করতে নেই। লোকে জানলে বাইরে মুখ দেখানো যাবে না।’ এর ফলে ঘরে ঘরে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী, এবং ধর্ষকরা সসম্মানে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে।
তবে, শারীরিক ধর্ষণ লুকানো কঠিন। মেয়েরা চেষ্টা করেও এসব ঘটনাগুলো চেপে রাখতে চায় যতক্ষণ সম্ভব। কিন্তু কখনো কখনো কিছু ঘটনা প্রকাশ পায়। তারপর শুরু হয় আইনি প্রক্রিয়া, যেখানে মেয়েটি পুলিশের কাছে, সাক্ষীদের কাছে, উকিলের কাছে, বিচারকের কাছে, এমনকি সমাজের কাছে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হয়।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১১,৭৫৮ নারী ও মেয়ে শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, এর মধ্যে ৬,৩০৫ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
কিন্তু ধর্ষণের মামলায় ৯৭ শতাংশের কোনো সাজাই হয় না। ফলে অপরাধী আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অর্থ ও ক্ষমতার বলয়ে থাকলে খুন-ধর্ষণ যেকোনো অপরাধ করেই পার পেয়ে যায়।
অথচ আইনের যুগোপযোগী পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। পুরোনো ব্রিটিশ আমলের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞাই এখনো অনুসরণ করা হচ্ছে। যদিও ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়, তবুও ধর্ষণের সংজ্ঞা এখনো ১৮৬০ সালের দ-বিধির উপরই নির্ভরশীল।
ধর্ষণ একটি ভয়ঙ্কর ফৌজদারি অপরাধ। ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন হোক, যদি তদন্ত সঠিকভাবে না হয়, নির্যাতিত নারীর দ্বিতীয়বার নির্যাতনের শিকার হতে হয়, এবং শাস্তির হার যদি মাত্র ৩-৪ শতাংশে আটকে থাকে, তবে ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু ধর্ষণ নয়, যে কোনো অপরাধের দ্রুত এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন, আইন এবং বিচারিক কাঠামোকে শুদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
আইনি ক্ষেত্রে অনেক সময় ধর্ষণের মামলা দ্রুত এগোয় না। দুর্বল আইনি কাঠামো, দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া, এবং সাক্ষীর অভাবের কারণে ধর্ষকরা সহজে পার পেয়ে যায়। অনেক সময় অপরাধীরা শক্তিশালী আইনগত সহায়তা বা সামাজিক অবস্থান থেকে সাহায্য পেয়ে শাস্তির হাত থেকে রেহাই পায়। অপরাধীকে দ্রুত শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এমন কোনো বিচারব্যবস্থা নেই যা ধর্ষণের শিকারদের নিরাপত্তা এবং সুবিচার নিশ্চিত করে।
এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আইনি ব্যবস্থার পুনর্বিবেচনা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের আইন ব্যবস্থা এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে ধর্ষকদের কোনো ফাঁকফোকর না থাকে এবং ধর্ষণের শিকার নারীরা দ্রুত ও কার্যকর বিচার পান। বিচারপ্রক্রিয়ায় দ্রুততা, স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা থাকতে হবে। তদুপরি, নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে যাতে তারা নিজেকে দোষী মনে না করে, বরং তাদের প্রতি সহানুভূতি এবং সমর্থন বৃদ্ধি পায়।
এটি শুধু আইনের কাজ নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরের দায়িত্ব হতে হবে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া। ধর্ষণ বন্ধ করার একমাত্র উপায় হল আইনি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, সমাজে সচেতনতা তৈরি করা এবং নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন বৃদ্ধি করা। অপরাধীরা যদি আইনের ফাঁকফোকরে মুক্ত হয়ে যায়, তবে সেই সমাজ কখনোই প্রকৃত শান্তি এবং ন্যায় পাবে না।
হুমায়ুন আহমেদ নাইম
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন