গত কয়েক মাসে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অনিশ্চয়তা ও বিতর্কের ছায়া পড়েছে, তা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। নির্বাচনের তারিখ কিছুদিনের মধ্যে ঘোষণার কথা থাকলেও সে ধোঁয়াশা কাটছে না, কারণ রয়েছে রাজনৈতিক দলের দাবি-দাওয়া, অনানুষ্ঠানিক চাপ ও বিতর্কিত কর্মকা-। বিশেষত জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা সাহসী শিক্ষার্থীরা যে রাজনৈতিক প্রবণতায় আকৃষ্ট হয়েছে, সেই নতুন দলের প্রতি সরকারি পক্ষপাতকে নিয়ে জনগণ অনিচ্ছা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এই বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকারের দ্রুত, স্বচ্ছ এবং সংকল্পবদ্ধ বিদায়-পরিকল্পনা ঘোষণা করা এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও সময়ের দাবি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ হলেও তার নেতৃত্ব দিয়েছেন বহু মেধাবী ও সাহসী তরুণরা। কিন্তু নেতৃত্বের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের আগেই তাদের নাম নানান বিতর্কে জড়ানো উদ্বেগজনক। চাঁদাবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার, মব জাস্টিস, এই ধরনের অভিযোগগুলো তরুণ নেতৃত্বের মর্যাদাহানি ঘটাচ্ছে এবং সমাজে বিভেদ বাড়াচ্ছে। সবচেয়ে জটিল বিষয়টি হচ্ছে, যদি সরকার কোনো রাজনৈতিক দলকে একপ্রকার সুবিধায় রাখে বা সামর্থ্য দেয়, তখন সেটি স্বাভাবিকভাবে ‘কিংস পার্টি’ বা বিশেষ স্বার্থসাধনের অরক্ষিত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যাখ্যাযোগ্য হবে। গণতান্ত্রিক উত্তরণে এ ধরনের পক্ষপাত কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর সমাজের আস্থা ভঙ্গ হয়েছে কারণ- সংস্কারের দাবিগুলো যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি; পতিত স্বৈরাচারের বিচার প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত অগ্রগতি দেখা যায়নি; এবং আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলোতে রদবদল ও সংস্কারের নামে কাজের অভাব লক্ষ্য করা গেছে। এসব কারণে রাজনৈতিক বিভেদ, আস্থা সংকট ও অনিশ্চয়তা জন্ম নিয়েছে, যা আগামী নির্বাচনের পরিবেশকে বেদখল করে দিতে পারে।
কেন এখনই ‘এক্সিট প্ল্যান’ ঘোষণা জরুরি:
১. নির্বাচনের স্তর-প্লেইং-ফিল্ড তৈরি : নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ভোটার তালিকা যাচাইকরণ ও প্রার্থী তালিকা প্রকাশের সময়সীমা নির্ধারিত হবে। এটি সবাইকে একই লেভেলে খেলতে বাধ্য করবে এবং সরাসরি ও পরোক্ষভাবে অনাকাক্সিক্ষত সুবিধা নেওয়ার সুযোগ কমাবে।
২. আস্থা পুনরুদ্ধার : উত্তরোত্তর বেড়ে থাকা সন্দেহ ও অনুমান থামাতে সরকারকে স্পষ্ট পরিকল্পনা দেখাতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের কাছ থেকে এমন ঘোষণা আস্থা বাড়াবে।
৩. বিচার ও সংস্কারের অবিচ্ছেদ্যতা নিশ্চিত করা : পতিত স্বৈরাচারের বিচার, দুর্নীতি অনুসন্ধান ও প্রশাসনিক সংস্কার যেন নির্বাচনের বাইরে না থেকে তার সঙ্গে তালমিলিয়ে এগোয়-এমনভাবে পরিকল্পনা ঘোষণাই পারে এ বাস্তবতাকে নিশ্চিত করতে।
অপ্রতিরোধ্য অপজিশনের ও চরমপন্থার রোড-ম্যাপ ব্যাহত করা : অনিশ্চয়তার সময়গুলোতে শত্রুপক্ষ বা অন্তর্দলীয় চক্রান্ত বাস্তবায়ন সহজ হয়। দ্রুত, নির্দিষ্ট সময়সীমাসহ বিদায়ের রোডম্যাপ এগুলোকে কার্যকারিতা হারাতে সাহায্য করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি পরিমার্জিত এক্সিট প্ল্যান ঘোষণার মাধ্যমে নি¤œলিখিত ধারা কার্যকর করতে হবে-
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা : নির্দিষ্ট দিন, মাস প্রকাশ করে নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে সব দল ও অংশগ্রহণকারী প্রস্তুতি নিতে পারে। ঘোষণা যেন বাস্তবে পালনযোগ্য এবং পরিষ্কার হয়।
ন্যূনতম সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার নির্ধারণ : নির্বাচন পরিচালনা, ইলেকটোরাল বডির স্বচ্ছতা, তথ্যপ্রদান ও মিডিয়ার ওপর সমতা, এসব ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারের তালিকা প্রকাশ করা। সংস্কারগুলোর প্রতিটি আইটেমের জন্য স্পষ্ট সময়সীমা এবং পর্যবেক্ষণ মাধ্যম থাকা উচিত।
পতিত স্বৈরাচারের বিচারপ্রক্রিয়ায় গতি আনা : বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য সাময়িক বিশেষ টাস্কফোর্স তৈরি ও নিরপেক্ষ মনিটরিং কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের অংশগ্রহণ বিবেচনা করা যেতে পারে; কমপক্ষে অগ্রগতির স্পষ্ট ডিলিভারি টার্গেট ঘোষণা করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে স্বচ্ছতা ও বদল : উচ্চপদস্থদের রদবদল ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাহিনীকে পেশাদার ও অরাজনৈতিক রাখা। অবিলম্বে অব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
জাতীয় ঐক্যমত পুনর্গঠন : সব প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আন্তঃপক্ষীয় মিটিং করে একটি সম্মতিপূর্ণ কোড-অফ-কন্ডাক্ট ও নিরীক্ষণ ব্যবস্থার উপর সম্মতি নেওয়া, যাতে নির্বাচনী মাঠকে স্থিতিশীল করা যায়।
খোলামেলা যোগাযোগ ও স্বচ্ছ প্রতিবেদন : প্রতিটি ধাপ সম্পর্কে জাতিকে নিয়মিত আপডেট দিতে হবে; যাতে সন্দেহ নির্মূল হয় এবং রাজনৈতিক আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়।
দেশবাসী আশা করে যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সুষ্ঠু আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; কোনো অপ্রত্যাশিত বিলম্ব না করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন, এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তরের পথ সুগম করবেন। একই সঙ্গে সব প্রধান দল, মফস্বল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও নাগরিক সমাজকে বিভক্ত হয়ে না থেকে সর্বাত্মক সমঝোতার পথে এগোতে হবে।
গণতন্ত্র বাজে নাটকে পরিণত হলে সমাজের তরুণ প্রজন্মই সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভাবী নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ যদি বিতর্ক ও ক্ষমতানিষ্ঠ রাজনীতিতে হারিয়ে যায়, তা দেশের ভবিষ্যৎ ক্ষুণœ করে। তাই এখনই দরকার একটি স্বচ্ছ, সময়বদ্ধ ও বাস্তবসম্মত এক্সিট প্ল্যান, যা নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বমানের করবে। এ পথই দেশের স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে কার্যকরভাবে সহায়ক হবে। সরকারের দ্রুত, দৃষ্টান্তমূলক ও ন্যায্য সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই আমরা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারি।
ফাহিম হাসনাত
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন