৫ আগস্ট ২০২৪। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের পতন ঘটে। সেদিন স্বৈরাচার হাসিনা গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে পালানোর খবরে দেশজুড়ে শুরু হয় বিজয় মিছিল। সেই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন ২১ বছর বয়সী তরুণ হৃদয় হোসেন।
কিন্তু সেই বিজয় মিছিলই তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সেসময় গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান এই যুবক। শুধু গুলি করে হত্যা নয়, পরবর্তীতে তার মরদেহও গুম করে ফেলে পুলিশ। গাড়িচালকের জবানবন্দিতে মিলেছে সেই গুমের শিকার হওয়ারও স্বীকৃতি। এক বছর পার হয়ে গেলেও হৃদয় হোসেনের সেই নিথর দেহের হাড়গোড়ও ফেরত পাননি তার বাবা-মা।
হৃদয়ের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর গ্রামে। তিনি বড় আশা নিয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ হলো না। এমনকি পরিবারের জন্যও কিছু রেখে যেতে পারলেন না।
হৃদয়ের মা রেহানা বেগমের হৃদয়বিদারক আহাজারি—‘আমরা কোনো বিচার চাই না, শুধু ছেলের হাড়গোড় হলেও ফেরত চাই। একটুকরো হাড় পেলেও বাড়ির উঠানে কবর দিতে পারতাম।’
পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পর হৃদয়ের মরদেহ গুম করে ফেলার অভিযোগ ওঠে। হৃদয়ের নাম এখনো শহীদদের তালিকায় ওঠেনি। পরিবারের সদস্যদের দাবি, সরকারি কোনো সহযোগিতাও তারা পাননি। গত এক বছর শুধু বুকভরা অপেক্ষা আর অশ্রুজলেই কেটেছে হৃদয়ের পরিবারটির।
হৃদয়ের বড় বোন জেসমিন আক্তার বলেন, ‘আমার ভাই শহীদের মর্যাদা পায়নি, কোনো স্বীকৃতি পায়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি।’
প্রায় এক বছর পর, গত বৃহস্পতিবার গাজীপুরের কড্ডা ব্রিজ এলাকার তুরাগ নদীতে হৃদয়ের মরদেহ উদ্ধারে অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিস। প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চলে এ তল্লাশি। অভিযানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কমিটির পরিদর্শক মাসুদ পারভেজসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
তদন্তে জানা গেছে, ৫ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে স্বৈরাচার হাসিনার পালানোর প্রতিবাদে আয়োজিত বিজয় মিছিলে অংশ নেন হৃদয়। সেখান থেকে তাকে আটক করে মারধর করেন পুলিশ সদস্যরা। একপর্যায়ে গুলি করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে তার মরদেহ ব্যক্তিগত গাড়িতে করে তুরাগ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ জানায়, মামলায় এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে হৃদয়ের মরদেহ নদীতে ফেলার কাজে ব্যবহৃত ব্যক্তিগত গাড়ির চালক রহিম (২৭) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গাজীপুর ডিবি উত্তর বিভাগের ওসি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রহিম আদালতে বলেছেন, পুলিশের নির্দেশে তিনি হৃদয়ের মরদেহ তুরাগ নদীতে ফেলে দেন। তার দেখানো স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই মরদেহ উদ্ধার সম্ভব হবে।’
হৃদয়ের বাবা মিয়া হোসেন বলেন, ‘ছেলেকে হারিয়ে আমরা বাঁচি না। শুধু একটুকরো হাড় পেলেও তাকে কবর দিয়ে শান্তি পেতাম।’
হৃদয়ের মা-বাবা, ভাইবোনের একটাই দাবি—হৃদয় যেন শহীদের মর্যাদা পায়, হত্যাকারীদের বিচার হোক, এবং পরিবার যেন অন্তত সামান্য হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সহানুভূতি পায়।
আপনার মতামত লিখুন :