ঢাকা বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৫

আধুনিকতার ভিড়ে বিলুপ্তির পথে দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী হোগলা শিল্প

আহাদ তালুকদার, আগৈলঝাড়া
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২৪, ০১:৫০ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্যময় হোগলা শিল্পের প্রতি এখন আর তেমন কদর নেই। কালের বিবর্তনে এই শিল্প বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়। এক সময় গ্রামের প্রত্যেক ঘরেই হোগলা শিল্প দেখা যেতো। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনে মক্তব, মসজিদ, মাদ্রাসা ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার হতো হোগলা পাতার তৈরি শীতল পাটি। বিশেষ করে গ্রামের সকল পেশার মানুষের খাওয়া, নামাজ ও ঘুমানোর কাজে এই পাটির ব্যবহার হতো সব থেকে বেশি। বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় তীব্র গরমে মানুষ হোগলা পাতার হাতপাখা ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। কিছু জনগোষ্ঠী খণ্ডকালীন আয়ের উৎস হিসাবে হোগলা পাতার কুটির শিল্পের ওপর নির্ভর করত।

তারা নদী, খাল ও ঝিলের কিনারা থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে জন্মানো এই জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে জীবনযাপন করত। কেউ কেউ বাজার থেকে এই জলজ উদ্ভিদ অর্থাৎ হোগল পাতা কিনে গ্রামীণ কুঁড়ে ঘরের বেড়া, ফসলের ক্ষেতে বেড়া, ঘরের ছাউনি ও ফসল রাখার টুকরি কাজে ব্যবহার করত। আবার গ্রামের নারীরা বাড়তি আয়ের উৎস হিসাবে কোমল ও নরম পাতা আলাদা করে তা দিয়ে শীতল পাটি, হাতপাখা, নামাজের মাদুর, কুশন, ঝুড়ি, টুপি ও টুকরিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে বাজারে বিক্রি করত। এসব পণ্য শহরের অনেক মানুষকেও ব্যবহার করতে দেখা যেত।

প্রাকৃতিকভাবে উপলব্ধ উপকরণগুলিকে উপযোগবাদী পণ্যে পরিণত করার সহজ দক্ষতা প্রাচীন সভ্যতার পর থেকে চলে এসেছে, কিন্তু এখনও ব্যবহারযোগ্য সকল সম্ভাবনার জন্য বাংলাদেশে সঠিক উদ্যোগের অপেক্ষায় রয়েছে।জলবায়ু পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী হাল্লাবলু এবং টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এগুলি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। হাতি ঘাস, বা হোগলা পাতার কথাই ধরুন যেমনটা বাংলায় বলা হয়। জল এবং পুষ্টির জন্য কম প্রয়োজনের সাথে, এটি বছরে কয়েকবার ফসল সংগ্রহ করা যায় এবং সূর্যের নিচে বেক করা হলে সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়। ঘাস বোনা হতে পারে মার্জিত অথচ শক্তিশালী হস্তশিল্প সামগ্রী যেমন ঝুড়ি, দড়ি, টুপি এমনকি ছাদ এবং বেড়ার মধ্যেও।

বরিশালে হস্তশিল্পের কারিগরদের দ্বারা ব্যবহৃত এটি সবচেয়ে সাধারণ কাঁচামাল, যদিও উৎপাদন বেশিরভাগই চাটাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ঈদুল আজহার সময়  পশু কোরবানির সময় এর  চাহিদার ব্যাপক। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের আগৈলঝাড়া, গৌরনদী, উপজেলায় ঘাস পাওয়া যায়। এবং সেখান থেকে বরিশাল সদর উপজেলার বাগধা, গৈলা, রাজিহার, বাকাল ইউনিয়নের এলাকার গ্রামবাসীরা চাটাই তৈরি করে। এটি কার্যত অনেক মহিলার আয়ের প্রধান উৎস। পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষদের জীবিকার এই ধরনে টিকে আছে। স্থানীয় কারিগররা পণ্যের বৈচিত্রের অভাব এবং দক্ষতা সম্পন্ন লোকের হ্রাসের কারণ উল্লেখ করে এই খাতের জন্য সরকারী সহায়তা চান। প্রায় ৩ হাজার পরিবার চাটাই তৈরিতে নিয়োজিত এবং যদিও কারুশিল্পটি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, তবে সাধারণত পণ্যের বৈচিত্রের অভাবে ব্যবসাটি সামান্য লাভ করে।

বরিশাল পতিশিল্প সমিতির উপদেষ্টা রফিকুল আলম বলেন, বর্তমানে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক পণ্য বাজারে আসায় ও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর প্রতারণায় ধ্বংস এই শিল্প। স্বল্প আয়ের মানুষের ধারণা, সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া হলে সারাদেশে হোগলা পাতা ও এর গুঁড়া বাজারজাত করা সম্ভব। তাছাড়া হোগল শিল্পের তৈরি নানা পণ্য বিদেশে রপ্তানি করেও দেশ ও জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যায়।

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার একজন হোগলা কারিগর সফর সরকার বলেন, একটি মাদুর তৈরিতে একজন একক ব্যক্তির একদিন লাগে, যা সাধারণত আকারের উপর নির্ভর করে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০টাকায় বিক্রি হয়।যাইহোক, যেহেতু অনেক কারিগর হোগলা বাগানের মালিকগন, তাদের উপকরণ কিনতে হবে। হোগলার এক বান্ডেলের দাম প্রায় ১০০০-৫০০০টাকা এবং এটি প্রায় চার বা পাঁচটি ম্যাট তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

মৃনাল সরকার বলেন, সাধারণত নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে পাতা সংগ্রহ করা হয় এবং সারা বছর শুকনো স্টোরেজে রাখা যায়। এলাকার আরেকটি হোগলা মাদুর প্রস্তুতকারী প্রভাতি সরকার জানান, তিনি তার পরিবারের সাহায্যে প্রতিদিন তিনটি হোগলা চাটাই তৈরি করে প্রতিদিন প্রায় ১০০০-১৫০০ টাকা আয় করতে পারেন।

তিনি আরো বলেন, আমরা যদি সরকারের সহযোগিতা পেতাম তাহলে আমরা অনেক বেশি হোগলা পণ্য তৈরি করতে পারতাম। এদিকে হোগলা ব্যবসায়ী পরেশ সরকার বলেন, ঈদুল আযহার সময় উপকরণের চাহিদা একটু বেড়ে যায়, যখন ভালো দাম পাওয়া যায়।

হোগলা মাদুর প্রস্তুতকারী আলো মনি বলেন, হোগল পাতা  জলজ উদ্ভিদটি এটেঁল মাটিতে জন্মে। নদীর, খাল ও ঝিলের কূলে হালকা জলাবদ্ধ স্থানে বেশি দেখা যায়।লম্বায় প্রায় ৫ থেকে ১২ ফুট হয়। যখন ১ থেকে ২ ইঞ্চি সারি সারি পাতার সমন্বয়ে বেড়ে ওঠে তখন সৃষ্টি হয় মনোমুগ্ধকর সবুজ পরিবেশ। বেড়ে ওঠার কিছুদিন পর এই জলজ উদ্ভিদে ফুলের জন্ম হয়। আর এই ফুল থেকে তৈরি হয় এক প্রকার পাউডার যা পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবারের উপাদান হিসোবে ব্যবহৃত হয়।

তিনি  জানান, আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে জন্মে থাকে এই উদ্ভিদ। নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাজে এই পাতা ব্যবহার ছাড়াও এর ফুল থেকে ফুল সংগ্রহ করে তা দিয়ে পাউডার তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা যায়। হোগল ফুলের পাউডারের প্রতি কেজির মূল্য প্রায় ৬০ থেকে ৮০ টাকা। এটি চকচকে হলুদ রঙের হয়। এ পাউডারটি খুব পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু খাবার। হোগলের গুঁড়া দিয়ে  কেক তৈরি করা  যায়। 

একজন ক্রেতা কামাল হাওলাদার  বলেন, হোগল পাতা আমাদের বাঙ্গালীর ঐতিহ্যের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে। বংশ পরম্পরায় আমরা এই পাতা বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকি। আমাদের ঘরের গৃহবধূরা গৃহস্থালি কাজে নানা ডিজাইনের পাটি, হাত পাখা, শিকে তৈরী সহ নানান রকমের জিনিস তৈরী করে।

তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আস্তে আস্তে এই ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যেতে বসেছে। বিক্রেতার সাজু পাল বলেন, তারা এক মোড়া বা আটি হোগল পাতা ১০০০-১২০০ টাকা দরে বিক্রি করে থাকেন, বাণিজ্যিক উৎপাদন না থাকায় চাহিদা মাফিক সরবারহ তারা সরবারহ করতে পারছেন না। বাঙ্গালীর এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে হোগলের সঠিক পরিচর্যা ও বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে খেয়াল রাখার দবি জানান তিনি।

হোগলা প্রস্তুতকারী রীতা রানী বলেন, আগের মত চাহিদা নেই হোগলার। আগে বিভিন্ন কাজে প্রচুর হোগলার ব্যবহার হতো। মানুষ দিন দিন হোগলার ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে। এতে করে তাদের আয় আগের চাইতে অনেকটাই কমে গেছে। তার উপরে করোনার ভাইরাসের কারনে বিকি-কিনি বন্ধ থাকায় তাদের আয় এখন নেই বললেই চলে। তাই তারা ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।

বরিশাল বিজনেস ফোরামের সেক্রেটারি রেবেকা সুলতানার মতে, যদি হোগলা ম্যাটগুলি ঐতিহ্যবাহী পণ্য হিসেবে বিবেচিত হত, তাহলে ব্যবসাটি আরও কমপক্ষে ১০,০০০ লোকের থাকার ব্যবস্থা করত। বর্তমানে বরিশাল জেলায় ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ মানুষ এই পেশার সাথে জড়িত। হোগলা থেকে তৈরি বিভিন্ন পণ্য চালু হলে এই খাত থেকে বার্ষিক ১০-২০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। “কিন্তু এটি করার জন্য, প্রশিক্ষণ এবং বিপণন প্রয়োজন,” তিনি মনে করেন।  হস্তশিল্প রপ্তানিকারক কারুশিল্প গ্রামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরুণ পাল বলেন, তিনি বগুড়া, নরসিংদী এবং নোয়াখালী জেলা থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ১ থেকে ২ কোটি টাকার হোগলা পণ্য কিনে থাকেন।

পাল বলেন, বরিশাল থেকে বিভিন্ন ধরনের হাতির ঘাসের পণ্য পাওয়া সম্ভব কিন্তু তা করার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।যদি স্থানীয় কারিগরবিভিন্ন ডিজাইনের উপর প্রশিক্ষিত হলে তাদের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানান।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি রঞ্জিত দত্ত বলেন, যদি গ্রামীণ শিল্পকে উন্নত করা হয়, তাহলে প্রতিটি গ্রামেই এর সুফল পাওয়া যাবে। দত্ত আরও বলেন, “এই এলাকার মানুষ আগেকার তুলনায় এখন অনেক দরিদ্র ছিল এবং নারীরা ব্যবসা থেকে উপার্জন করতে পারছে তা তাদের পরিবারে চরম দারিদ্র্য কমাতে সাহায্য করেছে।

বরিশালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন কার্যালয়ের উপ -মহাব্যবস্থাপক মো জলিশ মাহামুদ বলেন, হোগলা পাতার কৃষি ও অর্থনৈতিক গুন আছে। এটি আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের নদী ভাঙন প্রতিরোধে বিশেষ ভৃমিকা রাখছে। এ কারণে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ উদ্ভিদটি পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ করা গেলে কৃষি সেক্টরের উন্নয়নের মাইলফলকগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠতে পারে। সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া হলে সারাদেশে হোগলা পাতা ও এর গুড়া বাজারজাত করা সম্ভব হবে। বরিশাল সদর  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা  মো. মুনিবুর রহমান বলেন, হোগলা পাতার অথনৈতিক মূল্য রয়েছে। চরগুলো বেদখল হয়ে হোগলাপাতার বন কেউ যদি ধ্বংস করে থাকে তবে বা খোঁজ-খবর নিয়ে দ্ররত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উপজেলা পরিষদের আগামী বৈঠকে হোগলা পাতার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে এবং উপজেলা কৃষি  বিভাগের সাথে আলোচনা করে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া এ পাতাটি রক্ষায় করণীয় নির্ধারণ করা হবে। একই সাথে কৃষি বিভাগের সাথে সমন্বয় করে এটির নতুন নতুন বনায়ন সৃষ্টি বা পরিত্যক্ত ভৃমিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচারণা চালানো যেতে পারে।