ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের মেধাবী ছাত্রী নন্দিনী সরকার (১৮) আর কোনোদিন পরীক্ষার হলে বসবেন না। বুধবার (৮ অক্টোবর) ছিল তার শেষ পরীক্ষা। এর আগের দুটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছিল সে। কিন্তু তার আগেই ৫ অক্টোবর রাত ৩টা ১০ মিনিটে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় এই শিক্ষার্থীর।
নন্দিনীর মৃত্যু ঘিরে ক্রমশ জটিল ও রহস্যজনক হয়ে উঠেছে নানা তথ্য। তার মৃত্যু কি কেবলই মাদক সেবনের বিষক্রিয়া, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো অজানা ঘটনা? বিষয়টি এখন পুলিশের তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে।
মানিকগঞ্জ জেলার গিলন্ড গ্রামের ইজিবাইকচালক অনিল সরকারের বড় মেয়ে নন্দিনী। দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিনে ছোট বোন বিনা (১৭), চাচা গণেশ সরকারের স্ত্রী হাসি ও চাচাতো ভাই সমিরকে সঙ্গে নিয়ে ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ভাণ্ডারীপাড়ায় বিজন সরকারের বাড়িতে বেড়াতে যায় সে। অষ্টমীতে তাদের সঙ্গে যোগ দেন চাচা গণেশ সরকার, যিনি গাজীপুরের প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলস-এ ট্রান্সপোর্ট সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত।
গত ৩ অক্টোবর (শুক্রবার) তারা কুমার নদে নৌকা ভাড়া করে পূজার বিসর্জন উপভোগ করেন। ওই সময় তাদের সঙ্গে মিলের আরও দুই কর্মচারী ছিলেন বলে গণেশ সরকার জানান, তবে তাদের পরিচয় প্রকাশ করেননি।
পরদিন ৪ অক্টোবর সকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে নন্দিনী। সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রথমবার শৈলকূপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে এক নারী চিকিৎসক স্যালাইন দেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়।
রাত ১২টার দিকে অবস্থার অবনতি হলে আবারও হাসপাতালে নেওয়া হয়। এসময় চারজন চিকিৎসক তার শারীরিক পরীক্ষা করেন এবং অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে রেফার করেন। সেখানে রাত আনুমানিক ৩টা ১০ মিনিটে মারা যায় নন্দিনী।
নন্দিনীর মৃত্যু নিয়ে কুষ্টিয়া সদর থানার ওসি মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে আমাদের থানায় পাঠানো একটি স্লিপে মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাদকের বিষক্রিয়া উল্লেখ করেছেন কুষ্টিয়া হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. হোসেন ইমাম।’
ময়নাতদন্তও করা হয়েছে কুষ্টিয়া হাসপাতালেই। তবে এখনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। শৈলকূপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রেজিস্টারে নন্দিনীর চিকিৎসা ‘পুলিশ কেস’ হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। চিকিৎসকরা শারীরিক দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্টের কথা জানিয়েছেন, যা অতিরিক্ত মদ্যপানের ইঙ্গিত দেয় বলে ধারণা করছেন তদন্তকারীরা।
ঝিনাইদহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক গোলক মজুমদার জানান, ‘বাংলা মদ বা ক্যারু কোম্পানির তৈরি মদে সাধারণত বিষক্রিয়া হয় না। তবে ভেজাল বা বিষাক্ত পদার্থ মেশালে মৃত্যুঝুঁকি থাকে।’
একজন পরিদর্শকের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল এরই মধ্যে মাঠে কাজ শুরু করেছে। তারা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, ঠিক কী ধরনের মাদক বা মদ নন্দিনী সেবন করেছিল।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ হস্তান্তর না করায়, বিজনের প্রতিবেশী সঞ্জয় কুমার সরকার শৈলকূপা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন। মামলায় মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাদকের বিষক্রিয়া উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে পরে তিনি ফোনে জানান, ‘৫ অক্টোবর আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম, কী লিখেছি তা মনে নেই।’ তার দাবি, থানায় মামলার তথ্য পাঠানোর পরেই হাসপাতাল ময়নাতদন্ত করে মরদেহ বুঝিয়ে দেয়।
শৈলকূপা থানার ওসি মাসুম খান বলেন, ‘ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত করে বলা যাবে না।’
এদিকে নন্দিনীর মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা নেতিবাচক গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। এতে পরিবারটি গভীর শোক ও মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে বলে জানান তার চাচা গণেশ সরকার।
তিনি বলেন, ‘নন্দিনী খুব মেধাবী মেয়ে ছিল। মেডিকেল কলেজে পড়তো, সবসময় পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল। আমরা বুঝতেই পারিনি কীভাবে এমন হলো।’
বিজন সরকার বলেন, ‘বিসর্জনের দিন সে আনন্দ করেছে ঠিকই, তবে মদ্যপান করেছে কিনা জানি না। তবে বাড়িতে এত মানুষ ছিল যে কে কী করেছে, তাও বোঝা মুশকিল।’
গ্রামের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ৩ অক্টোবর বিসর্জনের দিন নন্দিনী, তার বোন বিনা ও আরও চারজন সমবয়সী নারী মিলে ছয়জন বাংলা মদ পান করেন। এরপর থেকেই নন্দিনী ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে থাকেন।
শৈলকূপা হাসপাতালের এক নারী চিকিৎসক নন্দিনীর কাছ থেকে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছিলেন বলেও জানা গেছে।
ধর্মীয় রীতিতে হিন্দুদের শ্মশানে দাহ করা হলেও, নন্দিনীর মরদেহ গ্রামের শ্মশানে না নিয়ে পারিবারিক জমিতে দাফন (মাটিচাপা) করা হয়। পরিবার সূত্রে জানা যায়, সামাজিক চাপ, পরিস্থিতির জটিলতা ও গুজবের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন তারা।
নন্দিনীর মৃত্যু নিয়ে সরকারের উচ্চমহল থেকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঝিনাইদহ জেলা পুলিশ প্রশাসনের তদারকিতে এরই মধ্যে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা ভাণ্ডারীপাড়ার বিজন সরকারের বাড়ি পরিদর্শন করেছেন।