ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপকে অতিরিক্ত ঋণসুবিধা দিতে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয় জনতা ব্যাংকের মতিঝিলের স্থানীয় শাখা ব্যবস্থাপককে।
ফলে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে এই শাখা থেকে বেপরোয়া ঋণসুবিধা (ঋণপত্র) নেয় গ্রুপটি। তখন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অনুমোদন করলেও সব ঋণের বিষয়ে জানতে পারেনি পরিচালনা পর্ষদ। এসব ঋণসুবিধা পরে সরাসরি ঋণে পরিণত হয়।
এর অনেকই আবার খেলাপি হয়ে পড়ে। ফলে এক জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। দেশে এখন সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকে।
সেই জনতা ব্যাংকের কাছে স্বল্পমেয়াদি অর্থায়ন হিসেবে, ৪০০ কোটি টাকার ক্যাশ ক্রেডিট (সিসি) ঋণ সুবিধা চেয়ে আবেদন করেছে বেক্সিমকো লিমিটেড। পাশাপাশি টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল কারখানাগুলো চালু রাখতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলার সুযোগও চেয়েছে।
একইসঙ্গে গত ডিসেম্বরভিত্তিক সব দেনা দুই বছরের মোরাটোরিয়াম সুবিধাসহ পাঁচ শতাংশ সুদে ১৫ বছর মেয়াদে পুনঃতপশিল করার অনুরোধ করেছে। কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা ও রপ্তানি অব্যাহত রাখার মাধ্যমে, দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকের দায়-দেনা পরিশোধ করতে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে বেক্সিমকো।
বেক্সিমকো লিমিটেডের মালিকানায় রয়েছেন সালমান এফ রহমান, যিনি ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টা ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে একই ধরনের দাবি জানায় বেক্সিমকো লিমিটেডের কর্মকর্তা ও শ্রমিকেরা। তারা অবিলম্বে বন্ধ সব কারখানা খুলে দেওয়া এবং লে-অফ প্রত্যাহারের দাবিও করে।
তবে নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, বেক্সিমকো শিল্পপার্কের বন্ধ কারখানাগুলো আবার চালু করা সম্ভব না।
এদিন সচিবালয়ে আয়োজিত ‘বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির’ বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, এসব কারখানার বিপরীতে এত দায়-দেনা রয়েছে যে চালানোর উপযুক্ততা হারিয়েছে।
গত ১৬ জানুয়ারি জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দেওয়া এক প্রস্তাবনায়, বেক্সিমকো টেক্সটাইল রপ্তানিমুখী কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত খরচ কমানো ও কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ২০২৫ ও ২০২৬ সালে কোম্পানির মুনাফা বাড়ানোর একটি পরিকল্পনা দিয়েছে।
বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ২০২৫ সালে আমাদের কাছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা নগদ উদ্বৃত্ত আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রয়োজনীয় ব্যয়ের চেয়ে রাজস্ব/বিক্রি খুবই কম হওয়ায় এমনটা হয়েছে।
এ ছাড়া প্রথম বছরে এই ব্যাবসায়িক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পিঅ্যান্ডএল এবং সিএফ-এ ফ্যাক্টর করা হয়েছে- ইতিমধ্যে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের পাশাপাশি ৮ হাজার শ্রমিক ও ৫০০ পরিচালন কর্মকর্তা ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হবে।
তবে আমরা যদি গত প্রান্তিকের মুনাফাযোগ্যতা দেখি, তাহলে প্রতি মাসে প্রায় ৪০ কোটি টাকার নগদ উদ্বৃত্ত আশা করতে পারি। ২০২৬ সালে কারখানা পূর্ণ সক্ষমতায় চালু রাখা সম্ভব বলে আমরা সুনিশ্চিত। যদি আমরা সর্বোচ্চ মাত্রায় উৎপাদন করতে পারি- তাহলে ২০২৬ সালে ৫৩৬ কোটি টাকা মুনাফা হবে বলে আশা করছি।
জনতা ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালে বেক্সিমকো লিমিটেড ৬ হাজার ১১১ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করে, ২০২৩ সালে যা ছিল ৩ হাজার ৭৬৬ কোটি এবং ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৫২ কোটি টাকা।
গত নভেম্বর মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়কে লেখা জনতা ব্যাংকের একটি চিঠি অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির কাছে বেক্সিমকোর মোট দেনা ২৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা; যার মধ্যে ১৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণিকৃত। বাকি প্রায় ৩ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা ওভারডিউ অবস্থায় রয়েছে।
বেক্সিমকো টেক্সটাইলস অ্যান্ড পিপিই ডিভিশনের আওতায় মোট ১৫টি প্রস্তুতকারক কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে বর্তমানে মাত্র তিনটি কোম্পানি- বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো পিপিই লিমিটেড এবং আরআর ওয়াশিং লিমিটেড চালু রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাকি ১২টি কোম্পানি ১৬ ডিসেম্বর থেকে লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকরা কারখানা চালু করতে আন্দোলন করছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনতা ব্যাংক বেক্সিমকোর শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন বাবদ অর্থ মঞ্জুর করেছে। সরকারও বাজেট থেকে এক মাসের বেতন পরিশোধ করেছে। তবে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারায়, রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের আগে জুলাই মাসে বেক্সিমকো টেক্সটাইলের কারখানাগুলোতে মোট শ্রমিক-কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৬৪৯, যার মধ্যে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৬৯৯। এরপর থেকে ৯ হাজার ৭৭৮ জন শ্রমিকসহ মোট ১০ হাজার ১১২ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী মে মাসের মধ্যে আরও ৮ হাজার শ্রমিক ও ৫০০ কর্মকর্তা কমানো হবে। তাতে বেক্সিমকো টেক্সটাইলে মোট শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২৬ হাজার ৩৭।
ওসমান কায়সার চৌধুরী বলেন, আমাদের ব্যাবসায়িক পরিকল্পনাটি খুবই বাস্তবসম্মত ও অর্জনযোগ্য। গত পাঁচ বছরে আমাদের রপ্তানি পারফরম্যান্স দেখলে বুঝতে পারবেন, প্রতি মাসে আমাদের গড় রপ্তানি ছিল ৩২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের। এ ছাড়া, ২০২২ সালে মাসিক গড় রপ্তানি ছিল ৫৯ মিলিয়ন ডলার।
বেক্সিমকো টেক্সটাইল আরও বলেছে, কিছু বিষয়ের ওপর তাদের ব্যাবসায়িক প্রক্ষেপণে ঝুঁকি থাকতে পারে। এর মধ্যে বিক্রয়, বিক্রয়মূল্য, আন্তর্জাতিক বাজারদর, জ্বালানি সরবরাহ এবং বিশেষত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিশেষভাবে গুরুত্ববহ।
বিক্রি ৫ শতাংশ কমলে মুনাফা কমবে ৯ শতাংশ। কিন্তু উপকরণ বা কাঁচামালে ১ শতাংশ ব্যয় কমানো গেলে মুনাফা বাড়বে ১০ শতাংশ।
এ ছাড়া, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নেরও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে বেক্সিমকো বলেছে, একটি সাধারণ মানদণ্ড অনুসরণ করলে, আমাদের মুনাফা কমবেশি ৫ থেকে ১০ শতাংশের মতো হতে পারে।

 
                            -20250126061322.jpg) 
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন