ঢাকা রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫

‘শিল্পীদের দুর্দশার জন্য অডিও কোম্পানি দায়ী’

রুহুল আমিন ভূঁইয়া
প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২৫, ০৭:০৬ পিএম
সংগীতশিল্পী তৌসিফ আহমেদ। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

‘বৃষ্টি ঝরে যায়’, ‘দূরে কোথাও’, ‘আমারে ছাড়িয়া’, ‘এ মনের আঙিনায়’, ‘জান পাখি’-সহ অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের শিল্পী তৌসিফ আহমেদ ভালো নেই। বেশ কয়েক বছর ধরে শারীরিক অসুস্থতার কারণে গানে অনিয়মিত একসময়ের জনপ্রিয় এই গায়ক।

এখন ঘরবন্দি কাটছে তার দিন-রাত। বর্তমান শারীরিক অবস্থা, নতুন গানের পরিকল্পনা ও অডিও কোম্পানির প্রতি আক্ষেপ নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে।

কেমন আছেন?

এই ভালো, এই খারাপ। এভাবেই এখন দিন-রাত যাচ্ছে। বছরখানেক আগে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। সেই সঙ্গে মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে ব্রেনের ডানপাশে রক্ত জমাট বাঁধে। সেই থেকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বিশ্রামে আছি। হার্টের সমস্যা সারতে সময় লাগবে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বাসা থেকে বের হচ্ছি না। বলা যায়, ঘরবন্দি সময় কাটছে। গান, সিনেমা ও নাটক এখন আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।

অনেকদিন কাজে নেই...

অবসরের এই সময়টা কিছু কাজের পরিকল্পনা করছি। শারীরিক অবস্থার একটু উন্নতি হলে কাজ শুরু করব। ভালো গান দিয়ে নতুন করে শুরু করতে চাই। ভালো গান আসবে কীভাবে—এখন তো গানের পৃষ্ঠপোষকতা নেই! অডিও কোম্পানিগুলো এখন আর গানে লগ্নি করছে না। তারা নাটক নির্মাণে ঝুঁকেছে। ফ্রি গান পেলে হয়তো প্রকাশ করে।

ছোটখাটো কিছু অডিও কোম্পানি গানে লগ্নি করছে। কিন্তু বড় কোম্পানিগুলো পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নিয়েছে গান থেকে। এখন নাটক দেখলেই টাকা। তাছাড়া বিজ্ঞাপন তো আছেই। যে কারণে তারা ভিউয়ের দিকে ঝুঁকেছে। একটি গান হিট হলেও সেভাবে কোম্পানিগুলো লগ্নি করার উৎসাহ দেখায় না। যে কারণে সেভাবে এখন আর গান হচ্ছে না। কিছু গান হচ্ছে তবে তা নাটকের জন্য।

আক্ষেপ হয়?

হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ একসময় আমাদের মতো শিল্পীদের দিয়ে অনেক কোম্পানিই কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে। বলা যায়, আজ তারা আমাদের চেনেই না! জোর গলায় বলতে পারি, আমাকে দিয়ে কোম্পানি মার্কেটে জায়গা করে নিয়েছে। সেই কোম্পানি এখন ইন্ডাস্ট্রিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু আমাকেই এখন চেনে না। শুধু আমি নই, আমার থেকে ভালো শিল্পীদেরও তারা এখন আর সুযোগ দিচ্ছে না। অথচ সোনালি সময় গান দিয়েই তারা বড় হয়েছে।

নতুন গান না করলেও পুরোনো গান নতুন করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করে ব্যবসা করছে, কিন্তু আমরা শিল্পীরা বঞ্চিতই রইলাম। আমরা কিন্তু গানের রয়্যালটি পাচ্ছি না। চুক্তি ছাড়াই কোম্পানিগুলো ব্যবসা করছে। ব্যাকস্টেজ থেকে এখন প্রচুর টাকা আসে। কিন্তু তা আমরা জানি না।

রয়্যালটি পাচ্ছেন?

না। যখন আমার গানগুলো শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নেয় তখন কিন্তু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ছিল না। তখন আমার গান মানুষ টাকা দিয়ে কিনে শুনত। ওয়েলকাম টিউনেও আমার গানগুলোর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল। আমি মনে করি, ওয়েলকাম টিউনে আমি ব্যতীত অন্য কেউ এগিয়ে নেই। সে সময় আমার গান দিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করে অডিও কোম্পানিগুলো। আমি বলছি না—গ্রামীণফোনের রিপোর্ট তা-ই বলছে।

আমারই অনেক গান এগিয়ে। কিন্তু এই সময় এসে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশের আগে কারও সঙ্গেই আমার কোনো চুক্তি হয়নি। বিষয়গুলো এখন কপিরাইট আইনের আওতায় আনলে বহু টাকা পাব বিভিন্ন কোম্পানি থেকে। সুস্থ হলে ব্যবস্থা নেব। কারণ, খারাপ সময়ে তারা আমার পাশে নেই। তাহলে তাদের আমি কী কারণে ছাড় দেবো? আমার ন্যায্য রয়্যালটি পেতে ব্যবস্থা নেব। এরই মধ্যে অনেক শিল্পী ব্যবস্থা নিয়েছে। সেই জায়গা থেকে আমি পিছিয়ে আছি।

শিল্পীদের দুর্দশা...

আজকে শিল্পীদের দুর্দশা এবং দুস্থ শিল্পী বলার পেছনে অডিও কোম্পানি দায়ী। কারণ কোম্পানিগুলো যদি শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মান দিত তাহলে খারাপ সময়ে কারও কাছে হাত পাততে হতো না। শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মানী কেউ-ই দেয় না। যে কারণে অনেকেই শেষ বয়সে উপায় না পেয়ে হাত পাতে। কেউ আবার না বলতে পেরে অর্থাভাবে মারা যান। আমি বলব, শতভাগ দায়ী অডিও কোম্পানিগুলো।

একসময় আমাদের মতো শিল্পীদের ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে। আজ তারা রাজার হালে। আর আমাদের মতো শিল্পীরা রাস্তার ফকির। জোর দিয়ে বলতে পারি শিল্পীর টাকায় পুরো একটা ভবন কিনেছে। অনেক কোম্পানি আছে একটি গানের টাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। সে ক্ষেত্রে তারা শিল্পীদের মূল্যায়ন করেনি। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

এখন গান কেমন হচ্ছে?

এখনো ভালো কিছু গান হচ্ছে। তবে মানুষের টেস্ট পরিবর্তন হয়েছে। দু-হাজার সালের দিকে এক ধরনের টেস্ট ছিল। পরবর্তী সময় দশ সালের দিকে এক ধরনের চাহিদা ছিল। এখন আরেক ধরনের। সময়ের এই পরিবর্তন মেনে এবং মাথায় নিয়েই কাজ করতে হবে। শিল্পীদের এক জায়গায় আটকে না থেকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

ভিউ...

আজকাল বুস্ট করে ভিউ বাড়ানো হয়। অনেক উদ্ভট কথার গান ভাইরাল হচ্ছে। ভিউয়ের দিক দিয়ে সেসব শিল্পীকে হিট বলা হয়। তবে এসব ভাইরাল মানুষজন শিল্পসত্তা ধ্বংস করছে। গানটি মানুষ কয়দিন মনে রাখল সেটাই হচ্ছে আসল বিষয়। আমার কাছে মনে হয় একজন শিল্পীর সবকিছু জানতে ২০ বছর পার হয়ে যায়। ২০ বছর পর যদি কেউ গান মনে রাখে তাহলে সে সফল। তিন মাস কিংবা ছয় মাস মনে রাখলে তা দিয়ে শিল্পীর বিচার করা যাবে না। তাদের আমার শিল্পীই মনে হয় না। ভাইরাল সাময়িক সময়ের জন্য। কিন্তু একটি গান সারা জীবনের।

আহ্বান...

অডিও কোম্পানির প্রযোজকদের নতুন করে গান নিয়ে ভাবা উচিত। কোম্পানিগুলো গানের ব্যাকস্টেজ থেকে ব্যবসা করেই যাচ্ছে। কিন্তু কেন নতুন গান এড়িয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। এগুলো তাদের ভাবা উচিত। একসময় শিল্পীরা সরে আসলে কোম্পানি কিন্তু আর থাকবে না। সে বিষয়েও তাদের মাথায় রাখা দরকার। অলরেডি নাটকের ভিউ পড়ে গেছে। যে কারণে উপার্জন কমে গেছে। বিজ্ঞাপনও আগের মতো নেই। ভালো নাটকের চেয়ে এখন অসংখ্য মানহীন নাটক হচ্ছে। সেই জায়গা থেকে বলব অতীত ভুলতে নেই।