ঢাকা বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫

আমাদের খাদ্য ও স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে কৃত্রিম রাসায়নিক

স্বাস্থ্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০২৫, ০৪:৩৩ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, খাবার ও কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত কিছু কৃত্রিম রাসায়নিক মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই রাসায়নিকগুলোর কারণে ক্যান্সার, স্নায়ুজনিত সমস্যা, বংশবৈচিত্র্য হ্রাস এবং ভ্রূণের বিকাশজনিত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে সতর্কতা জানানো হয়েছে যে, খাদ্য ব্যবস্থায় ব্যবহৃত কিছু কৃত্রিম রাসায়নিক — যেমন ফ্যাথালেটস, বিসফেনলস, পেস্টিসাইডস এবং পিএফএএস ‘ফরেভার কেমিক্যালস’ — মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে এবং কৃষি ও পরিবেশের ভিত্তিক কাঠামোকে দুর্বল করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই রাসায়নিকগুলোর কারণে প্রতিবছর স্বাস্থ্যব্যয় প্রায় ২.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের শীর্ষ ১০০ পাবলিক কোম্পানির মোট লাভের সমপরিমাণ। এছাড়াও, কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাস, পানি নিরাপত্তা বজায় রাখা ও পরিবেশগত ক্ষতি হিসাব করলে, এর অতিরিক্ত খরচ প্রায় ৬৪০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।

বিশেষত, এন্ডোক্রাইন ডিস্ট্রাপ্টরস — যেমন ফ্যাথালেটস ও বিসফেনলস — মানুষের প্রজনন সক্ষমতা হ্রাস করছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, চলমান মাত্রায় এই রাসায়নিকের সংস্পর্শ থাকলে ২০২৫ থেকে ২১শ শতকে ২০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন কম জন্মসংখ্যা হতে পারে।

এই গবেষণার পেছনে কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংস্থা, যেমন ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ হেলথ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল হেলথ, কেমসেক, এবং সিস্টেমিক।

প্রতিবেদনের মূল রিপোর্টাররা বলছেন, এই চার ধরনের রাসায়নিক নির্বাচন করা হয়েছে কারণ ‘এগুলো বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত এবং সবচেয়ে বেশি গবেষিত রাসায়নিক, যার মানব ও পরিবেশের উপর ক্ষতির প্রমাণ যথেষ্ট শক্ত।’

বিজ্ঞানী ফিলিপ ল্যান্ড্রিগান, শিশু স্বাস্থ্য ও বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ, প্রতিবেদনের ব্যাপক প্রভাব ব্যাখ্যা করে বলেন, রাসায়নিক দূষণ বিষয়টি ঠিক ততটাই গুরুতর, যতটা জলবায়ু পরিবর্তন। আমাদের বিশ্বকে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কৃত্রিম রাসায়নিকের উৎপাদন দ্রুত বেড়েছে। ১৯৫০-এর দশকের পর থেকে উৎপাদন ২০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমানে বাজারে রয়েছে ৩৫০,০০০-এর বেশি কৃত্রিম রাসায়নিক। তবে, এই রাসায়নিকগুলো ব্যবহার করার আগে নিরাপত্তা পরীক্ষার প্রক্রিয়া সীমিত এবং পরবর্তীতে এর প্রভাব পর্যবেক্ষণও কম।

প্রতিবেদনটি চার ধরনের রাসায়নিকের উপর আলোকপাত করেছে

ফ্যাথালেটস ও বিসফেনলস – প্লাস্টিকের প্যাকেজিং, খাবারের ডিসপোজেবল গ্লাভস ইত্যাদিতে ব্যবহৃত।

পেস্টিসাইডস – শিল্প কৃষিতে প্রয়োগ করা হয় ফসল রক্ষা ও পরিপক্বতা বজায় রাখার জন্য।

পিএফএএস – খাবারের পাত্র, পপকর্ন টাবস, আইসক্রিম কার্টনে ব্যবহৃত, তবে পরিবেশে জমে গিয়ে বাতাস, মাটি ও পানির মাধ্যমে খাবারে ঢুকে পড়ে।

এই সব রাসায়নিক হরমোন ব্যাঘাত, ক্যান্সার, জন্মগত অস্বাভাবিকতা, মেধাশক্তি হ্রাস এবং স্থূলতাসহ নানা রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত।

ল্যান্ড্রিগান বলেন, আমরা দেখছি, যেসব রোগে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে, তা সংক্রামক রোগের চেয়ে কম, তবে অ-সংক্রামক রোগ যেমন হৃদরোগ, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পেছনে অনেক কারণ থাকলেও, শিল্পজাত রাসায়নিকের দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শ একটি বড় কারণ।

তিনি আরও সতর্ক করে জানান, এগুলো শুধু প্রজাতির মেধা ও সৃজনশীলতা কমাচ্ছে না, বরং ভবিষ্যতের সমাজের জন্যও ঝুঁকি তৈরি করছে। এছাড়া আমরা প্রতিদিন হাজার হাজার রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসছি, যার প্রভাব সম্পর্কে আমরা জানি না।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই চার রাসায়নিকের ক্ষতি শুধুমাত্র ‘বরফের চূড়া’। বাস্তবে প্রতিদিনের খাদ্য ও পরিবেশে আমাদের আরও অসংখ্য রাসায়নিকের প্রভাব রয়েছে, যা আমাদের জানার বাইরে এবং যা নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি।

সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান