সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর ইঙ্গিতের কারণে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অনেকই প্রশ্ন তুলেছেন। এমন অবস্থায় সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই বিষয়ে দীর্ঘ একটি পোস্ট দিয়েছেন তিনি।
ওই পোস্টে আজাদ মজুমদার বলেন, প্রতিবেশীকে খুশি করতে আরেক প্রতিবেশীর থেকে দূরে সরে যাওয়া স্বাধীন জাতির পররাষ্ট্র নীতি হতে পারে না। অতীতে দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যা-ই ঘটুক না কেন, এখন থেকে এটি বাংলাদেশপন্থি নীতি হবে। যা আমাদের নিজস্ব স্বার্থে পরিচালিত হবে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ এক যুগ পর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সফরে এসেছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ। আর এই সফরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলি উত্থাপন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চালানো গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে পাকিস্তানকে। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের কাছে ৪.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাবি করেছে বাংলাদেশ।
অথচ, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রায়শই অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পাকিস্তানপন্থি হয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের এসব দাবি অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সন্দেহবাতিক ও সমালোচকদের মুখে এক চপেটাঘাত।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও আমনা বালুচের বাংলাদেশ সফর ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘ এক ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন উপ-প্রেস সচিব। যুগান্তর অনলাইন পাঠকদের জন্য যা হুবহু তুলে ধরা হলো- আমরা একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম, বাংলাদেশ কি তার পররাষ্ট্রনীতিকে পাকিস্তানপন্থি করে তুলছে?
যদিও এতে আমাদের মোটেও অবাক হয়নি। এমন কিছু লোক সবসময় থাকবে যারা বাংলাদেশের স্বাধীন পরিচয়ে খুব কমই বিশ্বাস করবে। তবে আমাদের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট ছিল। অতীতে দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যা-ই ঘটুক না কেন, এখন থেকে এটি বাংলাদেশপন্থি নীতি হবে, যা আমাদের নিজস্ব স্বার্থে পরিচালিত হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২৪ ঘণ্টারও কম সময় নিয়ে পাকিস্তানের সফররত পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচকে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার কথাগুলিকে কার্যকর করে। একই সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থের জন্য একসঙ্গে কাজ করার জন্য সম্মত হয়।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টিকারী একটি আবেগপূর্ণ বিষয় হল- ১৯৭১ সালে তার সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা এবং নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বিশ্বাস করতেন যে ক্ষমা চাওয়া সদিচ্ছা এবং অনুগ্রহের একটি কাজ হবে।
কিন্তু অতীতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সামরিক আমলাতন্ত্র সর্বদা এই ধরনের ধারণার বিরোধিতা করেছিল এবং তাই তারা কখনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চায়নি। বাংলাদেশ সম্পদের বিভাজনের বিষয়টির ওপরও জোর দিয়েছে, যা অতীতের শাসকদের জন্য একটি ভুলে যাওয়া বিষয় ছিল, যারা আলোচনার চেয়ে বিচ্ছিন্নতা পছন্দ করত।
একটি অনুমান অনুসারে, ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কমপক্ষে ৪.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাবি রয়েছে। অনুমানটি অভ্যন্তরীণ মূলধন সৃষ্টি, বহিরাগত ঋণ নিষ্পত্তি এবং বহিরাগত আর্থিক সম্পদ ধরে রাখার বিষয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল।
১৯৭০ সালের নভেম্বরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘূর্ণিঝড় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিদেশি দেশ/সংস্থাগুলি কর্তৃক অনুদানকৃত প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অতিরিক্ত দাবি বাংলাদেশের রয়েছে। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের লাহোর শাখায় স্থানান্তরিত হওয়ার আগে এই অর্থ ঢাকায় স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের অফিসে পড়ে ছিল।
আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন ছিল আরেকটি বিষয় যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অতীতে, পাকিস্তান তার প্রায় ১২৫,০০০ জনকে ফিরিয়ে নিয়েছিল, তবে বাংলাদেশের ১৪টি জেলার ৭৯টি শিবিরে প্রায় ৩২৫,০০০ জন রয়ে গেছে। এই বিষয়গুলিই দুই দেশের মধ্যে একটি সুস্থ এবং ভবিষ্যৎমুখী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।
আর সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম বিকল্প হলো আলোচনা, এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঠিক এটাই করার চেষ্টা করছে। দীর্ঘ বছর পর পাকিস্তানকে আলোচনায় এনেছে এবং একই সঙ্গে পারস্পরিক সুবিধার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা অন্বেষণ করার চেষ্টা করছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, এই বছরের শুরুতে মিশরে তার প্রতিপক্ষ শাহবাজ শরীফের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়, অমীমাংসিত সমস্যাগুলি সমাধানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন এবং বৃহস্পতিবার, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বালুচের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে, একই বৈঠকে, তিনি এই অঞ্চলের বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্কের উপর জোর দিয়েছেন।
পূর্ব শত্রুদের মিত্রে পরিণত হওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড শতাব্দী ধরে অসংখ্য যুদ্ধ করেছে, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাত মিলিয়েছে। একই যুদ্ধে আমেরিকা জাপানে বোমাবর্ষণ করেছিল, কিন্তু পরে এটিকে মিত্রে পরিণত করেছিল।
সম্ভবত বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের এগিয়ে যাওয়ার এবং ভবিষ্যতের সুবিধার জন্য অতীতের সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য একসঙ্গে কাজ করার সময় এসেছে। এক প্রতিবেশী থেকে দূরে সরে যাওয়া অন্য প্রতিবেশীকে খুশি রাখার জন্য একটি স্বাধীন জাতির পররাষ্ট্র নীতি হতে পারে না।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                    -20251031160223.webp) 
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন