বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান রাজধানীর উত্তরায় বিধ্বস্তের ঘটনায় ১৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। মারা গেছেন বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর। বিমানে তিনি একাই ছিলেন। দুর্ঘটনার পর সিএমএইচের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন তৌকির।
সোমবার (২১ জুলাই) বিকেল পৌনে চারটার দিকে সেখানেই তিনি মারা যান বলে নিশ্চিত করেছে আইএসপিআর। চীনা কোম্পানি চেংদু এয়ারক্রাফট কর্পোরেশনের তৈরি এফ-৭ বিজিআই বিমানে প্রশিক্ষণের শেষ মুহূর্তেই প্রাণ হারালেন তৌকির ইসলাম।
জানা গেছে, নিহত তৌকির পাবনা ক্যাডেট কলেজের ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। মাত্র ছয়মাস আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ক’দিন পরেই স্ত্রীকে নিয়ে হানিমুনে যাওয়ার কথা ছিল।
আজকের দিনটি হতে পারত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন। আজ জীবনের প্রথম সলো ফ্লাইট ছিল তার। তৌকির সফলভাবে এই ফ্লাইটটি সম্পন্ন করতে পারবেন সেই অপেক্ষায় ছিলেন তার সহকর্মীরা। এমনকি তৌকিরের জীবনের এই বিশেষ দিনটি উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা।
প্রশিক্ষণ চলাকালে একজন শিক্ষানবিস যখন যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠেন এবং তার প্রশিক্ষক মনে করেন, তিনি এককভাবে বিমান চালাতে প্রস্তুত, তখনই তাকে প্রথম সলো ফ্লাইটে পাঠানো হয়। এই ফ্লাইটে পাইলটকে সম্পূর্ণ একা সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়—রানওয়ে নির্বাচন, টেকঅফ, ইন-ফ্লাইট ম্যানুভারিং এবং ল্যান্ডিংসহ সবকিছু তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
এ বিষয়ে বিমানবাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, সলো ফ্লাইট একজন পাইলটের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। সফল ফ্লাইট শেষে সাধারণত জলখেলা হয় ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়। আজ রাতে তৌকিরের জন্য এসব আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। কে জানত, মাইলফলক অর্জনের এই দিনটিই তৌকিরের জীবনের শেষ দিন হবে।
এদিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ ওয়াহিদ উন নবী তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘ফাইটার বিমানে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির। সদ্য বিবাহিত। আগামী মাসে প্রমোশন। তৌকিরের বডি পাওয়া গিয়েছে দুর্ঘটনা থেকে বেশ দূরে। শরীরের বেশ ক্ষতি হয়েছে, একটা পা সম্ভবত ভেঙে গেছে, কান দিয়ে রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে আর শরীরে পালস আছে—আইসিইউতে রাখা হয়েছে। যদি বেঁচে যায় তাহলে দুর্ঘটনার পুরো কারণ জানতে পারবেন।’
বিমান দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের জন্য দোয়া চেয়ে তৌকির সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আজ ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের স্বপ্ন পূরণ হবার দিন। সাধারণত আমরা যারা বিমান বাহিনীতে পাইলট হিসেবে যোগ দেই, তাদের প্রথম স্বপ্ন থাকে আমরা হব একেকজন ‘টম ক্রুজ’ মানে ফাইটার পাইলট। অনেক যাছাইবাছাই কঠিন প্রশিক্ষণ শেষে এক কোর্সের হয়তো ১০ জনের মধ্যে মাত্র চারজন সিলেক্ট হয় ফাইটারের জন্য।”
দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষে আজকেই প্রথমবারের মতো একা ফ্লাই করেছিল তৌকির। তিনি জানান, ‘ট্রেনিং শেষে সে একা ফ্লাই করার কোয়ালিফাই হয়েছিল তিনদিন আগে। নিয়ম অনুযায়ী, যেদিন কোয়ালিফাই হবে সেদিনই প্রথম সলো ফ্লাই করা। তবে দুদিন আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না এবং পরদিন ছুটি থাকায় একা ফ্লাই করার অনুমতি পায়নি তৌকির ইসলাম।’
তিনদিন গ্যাপ হওয়ায় আজ (২১ জুলাই) তৌকিরের ইনস্ট্রাক্টর প্রথমেই তাকে নিয়ে আকাশে উঠেন এবং কিছুক্ষণ প্রাকটিস করান। এরপরে ইনস্ট্রাক্টর ডুয়েল সিট থেকে নেমে যান। ট্রেনিং ফ্লাইটে কোনো ভুল না করায় তৌকিরকে একা ছেড়ে দেন তার স্বপ্ন পূরণের জন্য। তৌকিরের টেক্সি (রানওয়েতে যাওয়ার আগে যতটুকু পথ যেতে হয়) টেকঅফ সবই ছিল ভালো।
তিনি আরও জানান, প্রথম একা ফ্লাই করার দিনে পুরো স্কোয়াড্রন সাজ সাজ রব থাকে ওয়েল কাম করতে, ইনস্ট্রাক্টর রানওয়ের পাশে সার্বক্ষণিক থাকে ওয়ারলেস নিয়ে যদি কোন সাহায্য বা গাইডেন্স লাগে। তৌকির টেকঅফ করার ৫-৭ মিনিটের মাথায় ইনষ্ট্রাক্টর দেখতে পান এক ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ। ফাইটার জেটটি বিমান বন্দরে উত্তর দিক থেকে ঘুরে দক্ষিণ দিকে উচ্চতা হারাচ্ছে। প্রশিক্ষক ওয়ারলেসে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিলেন।
মুহাম্মদ ওয়াহিদ উন নবী বলেন, ‘কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যা হবার তাই হলো, ফাইটার জেটটি এমন অবস্থায় ছিল যে নিশ্চিত বিমান বন্দরের ইন্টারন্যাশনাল পার্কিং বরাবর পড়ার কথা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তৌকির কিছু একটা করেছে হয়তো যা বিমানটিকে অন্য দিকে ডাইরেক্ট করেছে।
বিমানবাহিনীর সাবেক এই পাইলটের ধারণা, ফাইটার জেটটিতে কমপ্লিট কন্ট্রোল লস বা পাওয়ার লস (ইঞ্জিন ফেইল) এবং রেডিও ফেলুইর একসঙ্গে হয়েছে। সাধারণত, নতুন ফাইটার পাইলটদের একা প্রথম ফ্লাইটে সবচেয়ে ভালো বিমানটি দেওয়া হয়। কিন্তু তবুও কেন হলো বোঝা যাচ্ছে না। বিমান বাহিনীর ইতিহাসে প্রথম একা ফ্লাইটে এটাই প্রথম দুর্ঘটনা।
তিনি তৌকিরের নিহত হওয়ার ঘটনাকে সুইসাইড এটেমট বলতে নারাজ। তার মতে, ‘আমি সুইসাইড এটেমট বলতে নারাজ। কারণ পাইলট শেষ মুহূর্তে ইনজেক্ট করেছে। কারণ এইসব ক্ষেত্রে বডি পাওয়া যায় না, বিমানের সঙ্গে পুরোটাই বার্ন (পুরে যাওয়া) হয়ে যায়। পাইলট শেষ পর্যন্ত কোন কিছু চিন্তা না করে যদি আগেই বের হয়ে যেত তাহলে ক্ষয়ক্ষতি অন্যরকম হতো, আর নিজেই বেঁচে যেত অক্ষতভাবে। বিমান বাহিনীর অনেক পাইলট জানমালের ক্ষতি কমাতে শেষ মুহূর্তে ইনজেক্ট করে জীবন দিয়েছে, এইরকম বহু নজির আছে।’
অন্যদিকে বিমানবাহিনীর এক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘তৌকিরের আজ প্রথম একক মিশন ছিল, একটু আগে তিনি ডুয়াল ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন। এয়ারক্রাফট টেকঅফ করার একটুখানি যাওয়ার পর এয়ারক্রাফট কোন রিঅ্যাক্ট করছিল না। তারপরে এয়ারক্রাফট স্টল করে, তখন তার কন্ট্রোলে ছিল না। মোবাইল টাওয়ার থেকে তাকে ইজেক্ট করতে বলা হচ্ছিল, কিন্তু এত লোয়ার ফ্লাইয়িং হচ্ছিল যে, ওই সময়ে ইজেক্ট করা আসলে পসিবলও ছিল না। তিনি চেষ্টা করছিলেন যে, অন্যভাবে কিছু করা যায় কি না। কিন্তু দুর্ভাগ্য।’
তিনি আরও বলেন, ফ্ল্যাইটটি দিয়াবাড়ির ফাঁকা স্থানে ফেলতে চেয়েছিলেন তৌকির ইসলাম। এজন্য বেশ কিছু সময় ধরে চেষ্টাও চালাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি; জেটটি বাউন্স করে মাইলস্টোন এলাকায় গিয়ে আছড়ে পড়ে। শুরুতে তৌকির বেঁচে ছিলেন; তার পালস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখন তিনি আর নেই। এর আগে তাকে হেলিকপ্টার এমআই ১৭-তে করে রাজধানীর একটি সিএমএইচ হাসপাতালের ভর্তি করা হয়েছিল।