সোমবার, ৩০ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


দ্য ডিপ্লোম্যাট

প্রকাশিত: জুন ২৯, ২০২৫, ০৭:৩০ পিএম

বিশ্লেষণ

নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে ষড়যন্ত্র করছে ভারত!

দ্য ডিপ্লোম্যাট

প্রকাশিত: জুন ২৯, ২০২৫, ০৭:৩০ পিএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নেপালজুড়ে রাজতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বিক্ষোভকারী ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ছবি বা পোস্টার নিয়ে হাঁটছেন। এটা হঠাৎ করে হচ্ছে না, এই প্রতীকী বার্তাগুলোর পেছনে আছে গভীর রাজনৈতিক বার্তা। আসলে, এতে দেখা যাচ্ছে কীভাবে নেপালের পুরোনো রাজতান্ত্রিক স্মৃতি এবং ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদের বর্তমান ধারা একধরনের আদর্শিক সংযোগ তৈরি করছে।

ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তাদের আদর্শিক সংগঠন আরএসএস-এর অনেকেই মনে করেন, নেপালে আবার হিন্দু রাজতন্ত্র ফিরে আসা একদিকে ‘সভ্যতার বিজয়’, আরেকদিকে ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে দরকার। কারণ, তারা মনে করেন এটা ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করবে, বিশেষ করে যখন চীন এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে।

অনেক ভারতীয় ডানপন্থী মতাদর্শী ও রাজনীতিক যুক্তি দিচ্ছেন, যদি নেপালে একজন হিন্দু রাজা থাকেন, তবে তিনি সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে তুলতে পারবেন, দেশটিকে রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল করতে পারবেন এবং চীনের প্রভাবের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।

এই যুক্তি অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। ইতিহাস, নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভারতের কৌশলগত স্বার্থ সবকিছুকে বিবেচনায় নিলে বোঝা যায়, এই ধারণা বাস্তবতাবিবর্জিত ও দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। এটি নেপালের বাস্তবতা ও ভারতের আঞ্চলিক অবস্থান সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে পারে।

নেপালের রাজতন্ত্র নিয়ে এখন যে আবেগ ও স্মৃতিকাতর দেখা যাচ্ছে, তা বাস্তবে অতীতের চিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। অনেকেই ভাবেন নেপালের রাজতন্ত্র ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, কিন্তু সত্যিটা একটু ভিন্ন।

১৯৫০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সহায়তায় রাজা ত্রিভুবন নির্বাসন থেকে ফিরে এলে সবাই আশা করেছিলেন, নেপালে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র গড়ে উঠবে। কিন্তু সেই আশা বেশিদিন টেকেনি। ১৯৬০ সালে রাজা মহেন্দ্র এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্র ভেঙে দেন, ভারতপন্থী নেতাদের দমন করেন এবং চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার এই পথ অনুসরণ করেন তার ছেলে রাজা জ্ঞানেন্দ্রও, যিনি ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে আবার সরাসরি ক্ষমতা দখল করেন।

এই দুই রাজা ভারতকে কাছে টানার বদলে বরং ভারতীয় প্রভাব ঠেকাতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেন এবং নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভাষা ব্যবহার করেন। বিশেষ করে জ্ঞানেন্দ্রের সময়ে ভারত-নেপাল সম্পর্ক অনেক খারাপ হয়ে যায় এবং চীন সেই ফাঁক গলে নিজেদের কৌশলগত প্রভাব বাড়াতে সক্ষম হয়। তাই রাজতন্ত্র নেপালের জন্য কখনোই স্থিতিশীল শক্তি ছিল না, বরং অনেক সময় তা স্বৈরশাসন ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়েছে।

এখন নেপালে যে রাজতন্ত্রপন্থী আন্দোলন দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দাবি মিলেমিশে যাচ্ছে। কিন্তু হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে থাকা মানেই রাজতন্ত্রের পক্ষে থাকা নয়। যেমন, নেপালের অন্যতম প্রধান গণতান্ত্রিক দল ‘নেপালি কংগ্রেস’ হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণাকে সমর্থন করলেও তারা রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে। এটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য।

রাজতন্ত্র মানে একনায়কতন্ত্র বা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, আর হিন্দু রাষ্ট্রের দাবি অনেকটা সাংস্কৃতিক পরিচয় ও উদ্বেগ থেকে আসছে বিশেষ করে ফেডারেল শাসনব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং জনসংখ্যা পরিবর্তন নিয়ে।

তবে এই দুই দাবিই (রাজতন্ত্র ও হিন্দু রাষ্ট্র) এক জায়গায় এসে মিলছে, নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের হতাশা। ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারই তাদের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। ফেডারেল শাসনব্যবস্থার কথা বলা হলেও, অনেক সাধারণ নেপালি এটিকে দুর্নীতি ও অদক্ষতার প্রতীক বলে মনে করছেন। তারা মজা করে বলেন, ‘আগে আমাদের একজন রাজা ছিল, এখন আমাদের ৭৬১ জন’। এই হতাশার আবহেই রাজতন্ত্র ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

নেপালে রাজতন্ত্রপন্থীদের ভারতীয় বিজেপি ও আরএসএস-এর প্রতি ঝোঁক শুধু কৌশলগত সম্পর্কের কারণে নয়, বরং একটি আদর্শিক মিলের প্রতিফলন। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদ ও ধর্মভিত্তিক কেন্দ্রীভূত শাসনের পক্ষে। ভারতের যোগী আদিত্যনাথ, যিনি ধর্মীয় পরিচিতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মিশ্রণের প্রতীক, নেপালের অনেক রাজতন্ত্রপন্থীর কাছে আদর্শ মডেল। তাই নেপালের বিক্ষোভে তার ছবি দেখা নতুন কিছু নয়, বরং ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদের একধরনের রপ্তানি বলেই মনে করা যায়।

তবে ভারতের আগের কিছু কাজ নেপালে তার ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ১৯৮৯ ও ২০১৫ সালে ভারতের অনানুষ্ঠানিক অবরোধ নেপালে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে এবং ভারতের প্রতি মানুষের ক্ষোভ বাড়ায়। এর সঙ্গে রয়েছে ভারতের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা, যেগুলো অনেক সময় ভিত্তিহীন হলেও আবেগতাড়িত যেমন, ২০০১ সালে রাজপরিবারে ঘটে যাওয়া গণহত্যায় ভারতের কথিত ভূমিকা নিয়ে গুজব।

এই প্রেক্ষাপটে চীন ‘অ-হস্তক্ষেপকারী’ বন্ধু হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছে। তারা অবকাঠামো, নরম কূটনীতি এবং নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে নেপালে প্রভাব বিস্তার করছে। অন্যদিকে, ভারতের রাজতন্ত্রপন্থী ভাবনার প্রতি আগ্রহ নেপালের গণতান্ত্রিক দলগুলোকে দুর্বল করতে পারে এবং ভারতের প্রভাব ক্ষয়িষ্ণু করতে পারে।

তবে রাজতন্ত্র ফিরে এলেও নেপালের প্রধান সমস্যাগুলোর সমাধান হবে না, যেমন- যুবসমাজের বেকারত্ব, গ্রামীণ দারিদ্র্য এবং অভিজাতদের কর্তৃত্বপূর্ণ শাসনব্যবস্থা। বর্তমানে ৪০ লাখের বেশি নেপালি বিদেশে কাজ করে এবং রেমিট্যান্স দেশটির মোট অর্থনীতির ৩০ শতাংশের মতো। নেপালের অর্থনীতি এখনো অনেকখানি ভারতের উপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে বাণিজ্য, বিদ্যুৎ এবং পরিবহন খাতে।

এই খাতে ভারত অনেক বিনিয়োগ করেছে, যেমন ৯০০ মেগাওয়াটের অরুণ-তৃতীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা জয়নগর-বারদিবাস রেলপথ। এছাড়া, আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সংযোগ ও বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) উদ্যোগ নেপালকে আঞ্চলিক পর্যায়ে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির রপ্তানিকারক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এই ধরনের ব্যবহারিক ও বাস্তব ভিত্তির সম্পর্কই টেকসই, আদর্শিক আবেগ নয়।

নেপালের নির্বাচিত কমিউনিস্ট নেতারা যদিও মাঝেমধ্যে ভারতবিরোধী ভাষণ দেন, কিন্তু বাস্তবে তারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। পুষ্প কমল দহল ও কেপি শর্মা ওলির মতো নেতারা ভারতের সমর্থন ছাড়া দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। এমনকি যারা ফেডারেল শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করেন, তারাও রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পক্ষে নন, তারা চান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংস্কার।

সবশেষে, রাজতন্ত্র পুনর্বহালের চিন্তা কোনো বাস্তবভিত্তিক কৌশল নয়, বরং এটি একটি আদর্শিক কল্পনা। ভারত যদি নেপালে চীনের প্রভাবের মোকাবেলা করতে চায় এবং দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ক দৃঢ় করতে চায়, তাহলে তাকে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বহুস্তরীয় অংশীদারিত্বে বিনিয়োগ করতে হবে। কাঠমান্ডুতে যোগী আদিত্যনাথের পোস্টার ভারতের কিছু গোষ্ঠীকে আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু এটি নেপালের অনেক নাগরিক এবং ভারতের কূটনৈতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি করে।

 

মূল লেখা: সহস্রাংশু ড্যাশ, গবেষক, সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।

Link copied!