শনিবার, ০২ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আব্দুল আহাদ

প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২৫, ০২:৪৩ পিএম

মতামত

শুক্রবারের আহ্বান: নৈতিকতার চর্চা ও পারিবারিক বন্ধনের দিন

আব্দুল আহাদ

প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২৫, ০২:৪৩ পিএম

ছবি- সংগৃহীত

ছবি- সংগৃহীত

‘আজ শুক্রবার। সপ্তাহের এমন একটি দিন, যেদিন শহরের ব্যস্ততা যেন একটু থেমে যায়। মুসলিম সমাজের কাছে এই দিনটি শুধু ছুটির নয়, আত্মবিশুদ্ধির এক অনন্য সুযোগ। কোরআন ও হাদিসে এই দিনের গুরুত্ব নিয়ে রয়েছে অসংখ্য বার্তা—বিশেষ করে জুমার নামাজ ও খুতবার মাধ্যমে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার একটি শক্তিশালী উপায় হিসেবে...’

সপ্তাহের ছয় দিন ছুটে চলা জীবনে, শুক্রবার যেন এক স্বস্তির নিশ্বাস। পেশাগত ব্যস্ততা, শহরের জটলা, সময়ের অনবরত চাপ—এই সবকিছুর মাঝখানে শুক্রবার এসে দাঁড়ায় এক ধরনের আত্মবিশ্লেষণের আহ্বান নিয়ে।

শুধু একজন সংবাদকর্মী নই, বরং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি প্রায়ই লক্ষ করি, শুক্রবারের দুপুর শহরের এক অন্যরকম রূপ নেয়। মসজিদের পাশ দিয়ে গেলে দেখা যায়, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে ছুটে চলেছে মানুষ, কেউ গাম্ভীর্য নিয়ে, কেউ তাড়াহুড়ায়। ছোট ছোট বাচ্চারা বাবার হাত ধরে যাচ্ছে নামাজে। বয়স্করা হয়তো হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাচ্ছেন পরিচিত মসজিদে।

ইসলামের দৃষ্টিতে এই দিনের গুরুত্ব নতুন করে বলার কিছু নেই। কোরআনের ভাষায়, ‘হে ইমানদারগণ! যখন জুমার দিনে নামাজের আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় পরিত্যাগ করো। এটিই তোমাদের জন্য উত্তম—যদি তোমরা জানো।’ (সুরা আল-জুমা, আয়াত ৯)।

এ আয়াতের প্রতিধ্বনি যেন প্রতিটি মসজিদের মাইকে প্রতিটি শুক্রবার দুপুরে শোনা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সূর্য যেদিন উদিত হয়েছে তার মধ্যে শুক্রবার সর্বোত্তম দিন।’ (সহিহ মুসলিম)।

তবে আমার অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, শুক্রবারের গুরুত্ব শুধু ধর্মীয় পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ নয়। এই দিনটি হয়ে উঠেছে এক সামাজিক, পারিবারিক এবং নৈতিক বোধের প্রতিচ্ছবি।

আমি যখন ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাই—এক মফস্বল শহরের কাছাকাছি ছোট্ট এক গ্রাম—তখন দেখি শুক্রবার মানেই একধরনের উৎসব। সকাল থেকেই প্রস্তুতি, গোসল, ভালো জামা, আতর লাগানো, বাজার করা। হাটও হয় শুক্রবারে। অনেকেই নামাজের পর একসঙ্গে বসেন গল্প করতে, চা খেতে, স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে। মসজিদ শুধু নামাজের জায়গা নয়, হয়ে ওঠে মতবিনিময়ের জায়গাও।

শহরে এই চিত্র কিছুটা ভিন্ন হলেও তার রেশ আছে। শুক্রবার অনেকটা ‘ধর্মীয় ছুটি’র চেয়ে ‘সামাজিক সংযুক্তি’র দিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মব্যস্ত বাবা-মা সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পান এই দিনেই। স্কুলছুট ছেলেমেয়েরা পায় টেলিভিশনের সামনে বসে পরিবারের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ। অনেক পরিবার এই দিনেই চেষ্টা করে একসঙ্গে খাওয়ার আয়োজন করতে।

এই পারিবারিক বন্ধনের দিনে নৈতিক চর্চার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। জুমার নামাজের খুতবা যদি শুধুই আরবিতে পড়ে দেওয়া কোনো নিষ্প্রাণ রেওয়াজ না হয়ে ওঠে, বরং সমাজ-বাস্তবতা ঘেঁষা দিকনির্দেশনামূলক বার্তা হয়ে দাঁড়ায়—তাহলে তা হতে পারে গভীর সামাজিক প্রভাব ফেলার হাতিয়ার। দুর্নীতি, অসততা, মিথ্যাচার, সহিংসতা, পারিবারিক অবক্ষয়—এসবের বিরুদ্ধে জুমার খুতবাই হতে পারে সাপ্তাহিক প্রতিরোধ-ব্যবস্থা।

একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। কয়েক সপ্তাহ আগে আমি সিলেটের একটি বড় মসজিদে জুমার নামাজে ছিলাম। ইমাম সাহেবের খুতবার বিষয় ছিল ‘পরিবারে দায়িত্ববোধ ও পুরুষদের আচরণ’। বেশ কিছুক্ষণ তিনি ব্যাখ্যা করলেন—কীভাবে ঘরের মধ্যে পুরুষরা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, অথচ যেন সেটা কর্তৃত্ববাদী মনোভাবে পরিণত না হয়। 

তিনি বলছিলেন, ‘প্রতিদিনের কাজের চেয়ে পরিবারে ন্যায়পরায়ণতা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পরিবারই একটি জাতির শুরুর জায়গা।’ শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছিল—এই বক্তব্যটি একটি কলামে তুলে ধরলে হয়তো আরও বহুজন উপকৃত হতেন।

এমন খুতবা যদি আরও বেশি হয়—সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বাড়াতে, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে—তাহলে শুক্রবার একটি সামাজিক বিপ্লবের দিন হয়ে উঠতে পারে।

খুব সাম্প্রতিক এক শুক্রবারে, আমি সিলেটের একটি নামকরা মসজিদে খুতবা শুনছিলাম। ইমাম সাহেব বলছিলেন, ‘সততা শুধু ব্যক্তিগত গুণ নয়, এটা জাতি গঠনের মূলভিত্তি।’ আমি চুপচাপ নোট নিচ্ছিলাম—সাংবাদিকের অভ্যাসবশত। মনে হলো, এর চেয়ে বড় সংবাদ আর কী হতে পারে?

আমাদের উচিত, শুক্রবারকে আরও অর্থবহ করে তোলা। শুধু নামাজ নয়, পরিবারে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা, ছোটদের নৈতিক গল্প শোনানো, পাড়ায় বৃদ্ধদের খোঁজ নেওয়া—এই ছোট ছোট উদ্যোগগুলোই হতে পারে সমাজ বদলের সূচনা।

আমার মতে, আজকের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই দিনের গুরুত্ব নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা জরুরি। শুধু বলা যাবে না—‘জুমা পড়ো, এটা ফরজ’, বরং বোঝাতে হবে—‘এই দিনটি তোমার আত্মবিশ্লেষণের, নিজেকে গড়ার, অন্যকে সম্মান করার শিক্ষা গ্রহণের দিন।’ খুতবায় যদি তরুণদের ভাষা ও সমস্যা উঠে আসে, তারা তা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করবে।

আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা প্রায়ই দেখি, নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে যখন রিপোর্ট প্রকাশ হয়, তখন তা একদিনের তুফান তোলে—তারপর আর কেউ মনে রাখে না। কিন্তু যদি প্রতিটি শুক্রবার সমাজের প্রতিটি মসজিদ থেকে নিয়মিতভাবে মূল্যবোধের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা হবে অনেক বেশি কার্যকর। কারণ এটি আসে বিশ্বাসের জায়গা থেকে।

শুধু ইমাম সাহেব নন, সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি, মিডিয়া, শিক্ষক, এমনকি অভিভাবকরাও শুক্রবারকে কেন্দ্র করে নৈতিক আলোচনা শুরু করতে পারেন। এক কাপ চায়ের টেবিলেও যদি আমরা বলি, ‘আজ খুতবায় দুর্নীতি নিয়ে ভালো কথা বলেছে’- তবেই হয়তো সমাজে ‘নরম শক্তি’র একটা ঢেউ তৈরি হবে।

আজ যখন পরিবার ভাঙছে, সমাজে সহিংসতা বাড়ছে, আত্মকেন্দ্রিকতা ও হতাশা গ্রাস করছে তরুণদের—তখন শুক্রবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ধর্মীয় অনুশাসন কেবল আচার নয়, তা জীবনের প্রতিটি স্তরের জন্য রূপকাঠি। তাই শুক্রবার হোক শুধু ছুটির দিন নয়, একটি শিক্ষা, সংলাপ ও সংশোধনের দিন।

আমাদের উচিত, শুক্রবারকে আরও অর্থবহ করে তোলা। শুধু নামাজ নয়, পরিবারে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা, ছোটদের নৈতিক গল্প শোনানো, পাড়ায় বৃদ্ধদের খোঁজ নেওয়া—এই ছোট ছোট উদ্যোগগুলোই হতে পারে সমাজ বদলের সূচনা।

গণমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে আমি জানি, ছোট একটি বার্তা, একটি মানবিক গল্প কিংবা সময়োপযোগী লেখা কতটা প্রভাব ফেলতে পারে। তাই শুক্রবার নিয়ে আমাদের লেখালেখি, প্রচার কিংবা সংলাপ হওয়া উচিত আরও গভীর ও সচেতনতার সঙ্গে। শুক্রবার কেবল ছুটির নয়, হোক আত্মশুদ্ধি ও দায়িত্বের স্মারক।

লেখক: সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী

Shera Lather
Link copied!