জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন বা এফএও) গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ঘোষণা করেছে, বিশ্বের মধ্যে খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে চীন ও ফিলিপাইনের পর বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। অর্থাৎ, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও খাদ্যঘাটতিতে দেশ। এই খবরের মধ্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মাত্র ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দেশে ২০২২ সালে ১৬ কোটি ৯৮ লাখের বেশি জনসংখ্যা রয়েছে বলে সর্বশেষ জনশুমারিতে নির্ণয় করা হয়েছে। সন্দেহ রয়েছে, প্রকৃত জনসংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত সরকারি সংস্থা ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (বিএমইটি) হিসাব মোতাবেক দেশের ১ কোটি ৫৫ লাখেরও বেশি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হিসেবে বসবাস ও কর্মরত, যাদের জনশুমারির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ জনসংখ্যার এই দেশ বড় জনসংখ্যার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়, লুক্সেমবুর্গ ও সিঙ্গাপুরের মতো কয়েকটি সিটি-স্টেটকে বাদ দিলে। অতএব, এই ঘনবসতিপূর্ণ ও ভূমিদরিদ্র দেশে খাদ্য আমদানি করতে হবে, ব্যাপারটা স্বাভাবিক।
স্বাধীনতার পর থেকে উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ, তবু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। বাজারে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামে নাকাল অবস্থা মধ্য ও নিম্নবিত্তের।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, একদিকে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি পুরোপুরি ব্যবহার শুরু করা যায়নি, অন্যদিকে বাজার চলে গেছে সিন্ডিকেটের কব্জায়।
দেশে পণ্যের দাম একবার বাড়লে আর কমার লক্ষণ থাকে না। বিশ্বে মূল্যবৃদ্ধির এমন বিরল চিত্রের দেখা মিলবে বাংলাদেশে। এতে বঞ্চনার শিকার কেবল সাধারণ মানুষ। শুধু তাই নয়, সরকারি কাগজে-কলমে মূল্যস্ফীতির গত কয়েক বছরে যে হিসাব দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তার পরিমাণ অনেক বেশি।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে দেশের ধানের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ, ১০ গুণ বেড়েছে গম উৎপাদন। সবজি ও মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৪ থেকে ৭ গুণ। তার পরও কেন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারছে না বাংলাদেশ?
এ বিষয়ে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমাদের সমসাময়িক দেশগুলো যেভাবে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে।
বিআইআইএসএসের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবির বলেন, ‘আমাদের বাজারব্যবস্থা পুরোপুরি সিন্ডিকেট-ভিত্তিক হওয়ায় এবং তাদের ব্যাপক প্রভাব থাকার কারণে আমরা সুফল পাচ্ছি না। কৃষকেরা দাম পাচ্ছেন না। তারা ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে যারা কৃষি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, খাদ্যপণ্যের ব্যবসা যারা করছেন, তারা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন। তারা অর্থ পাচার করছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কারসাজিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে এই নব্য স্বাধীন দেশটি অর্থনৈতিকভাবে আদৌ টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে বিশ্বের অনেক উন্নয়ন-অর্থনীতিবিদ ও ওয়াকিবহাল মহলের গভীর হতাশা ছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জনসন নামের যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনীতিক যখন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের তদানীন্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত সেক্রেটারি অব স্টেট ড. হেননি কিসিঞ্জার তাতে সায় দিয়েছিলেন।
কারণ তখন বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ টন খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল। ওই সময় আমাদের চাল লাগত ১ কোটি ৫০ লাখ টন, কিন্তু আমরা উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন। বাকি ৪০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় ঘাটতি পূরণের জন্য বিশ্বের দাতা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে খাদ্যসাহায্যের জন্য ভিক্ষার হাত পাতা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
দীর্ঘ বছর পর ১৯৯৯ সালে আমরা ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিলাম প্রথমবারের মতো, কিন্তু কৃষিতে ভুল নীতি আবার দেশকে খাদ্য ঘাটতির গহ্বরে নিক্ষেপ করে। ২০০৭-০৮ সালে দেশ মারাত্মক খাদ্য ঘাটতির ঝুঁকিতে পড়ে।
ওই সংকটের সময় বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে খাদ্যশস্য আমদানি করার জন্য তখনকার সরকার মরিয়া প্রয়াস চালালে অনেক দেশ খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে রাজি হয়নি। কারণ, সারা বিশ্বে ওই সময়ে খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টির শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। এরপর গত ১২ বছরের মধ্যে ২ বছর ছাড়া ১০ বছর দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে চলেছে কিংবা উদ্বৃত্ত ধান উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে।
কৃষি খাতের এই সাফল্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইয়ে দিলেও আবারও আমাদের দেশ পিছু হঠা শুরু করে নানান কারণে। যদিও গত ৫৩ বছরে ধান উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯২ লাখ টনে, ভুট্টা ও গম উৎপাদন যোগ করলে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ টন। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে গেছে। তরিতরকারি, শাকসবজি, আলু, হাঁস-মুরগির মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
ওপরে উল্লিখিত সাফল্যগুলোকে খাটো না করেও স্বীকার করতে হবে যে খাদ্য আমদানিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ আমদানিকারক দেশ বাংলাদেশ।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন