ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৮৮৩ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। সাঈদ খোকন ও ব্যারিস্টার তাপস- দুই মেয়রের সময়কালেই এই পুকুর চুরির ঘটনা ঘটেছে।
করপোরেশনের নানা প্রকল্পে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে অর্থ লোপাটের যেন মহোৎসব চলেছে। চাউর আছে, খোদ মেয়ররাই এসব লুটপাটের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মহাদাপুটে মেয়ররা এখন নেই, রয়ে গেছেন তাদের দোসররা। এই সময়েও ওই দোসররা টুকটাক লুটের ঘটনায় জড়িয়ে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পতিত সরকারের আমলে কাজ না করেই বিল তুলে নেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন নিম্নমানের ও ন্যূনতম হলেও সবকিছুই জায়েজ হয়ে গেছে।
ওই লুটেরাদের দোসররা ডিএসসিসিতে এখন দাপটের সঙ্গে রীতিমতো রাজত্ব করছেন। বলাবলি হচ্ছে, তারা নাকি গোটা ডিএসসিসিতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন। এখনো তাদের বলার কেউ নেই। ছোঁয়ারও কেউ নেই।
লুটপাটের ফিরিস্তি : ব্যারিস্টার তাপস মেয়র থাকাকালে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে শাহবাগের শিশুপার্ক উন্নয়ন প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়।
প্রথমে এর ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয় ৭৮ কোটি টাকা। পরে এর ব্যয় বরাদ্দ সব সীমা পেরিয়ে এক লাফে এসে দাঁড়ায় ৬০৩ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পে ৪৪১ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয় শিশু পার্কটির ১৫টি রাউড কেনা ও প্রতিস্থাপনের কাজে। শুধু তাই না, এসব রাইডের দরদামও দেখানো হয়েছে অবিশ্বাস্য অংকের।
এদিকে ডিএসসিসির আওতাধীন শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল এবং সারুলিয়া এলাকার সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের নজিরবিহীন লুটের ঘটনা ধরা পড়ে গেলে হৈচৈ পড়ে যায়।
৬৮১ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দের এই প্রকল্পের ১৫৪ কোটি টাকাই চলে যায় সংশ্লিষ্টদের পকেটে। এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলে ২০২৪ সালের ২৫ মে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
প্রধান বর্জ কর্মকর্তাকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটি প্রতিবেদন দাখিলের কথা থাকলেও সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
জানা যায়, প্রকল্প পরিচালক বোরহানউদ্দিন এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মিথুন শীল প্রতিবেদনটি আলমিরায় তালাবদ্দ করে রেখেছেন। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের ৩৮ কোটি টাকার পুরোটাই লোপাট হয়ে গেছে।
এমন প্রমাণ সম্প্রতি পেয়েছে দুুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের তদন্তে ওঠে এসেছে, এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে স্মার্ট ট্রাফিক সিগন্যাল বসানোর কথা ছিল। এর নিয়ন্ত্রণের ভার পড়ে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ওপর।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সিগন্যাল বসানো তো দূরের কথা, ডিএসসিসিতে কোনো নিয়ন্ত্রণ কক্ষের অস্তিত্বই নেই। দুদক তদন্ত দল যেখানে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপিত হওয়ার কথা, সেখানে আনসার সদস্যদের শয়নকক্ষ দেখতে পান।
এদিকে হাজারীবাগ কসাইখানা নির্মাণের নামেও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। ২ কোটি ৯৪ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫০ টাকা ব্যয় বরাদ্দের এই প্রকল্পে স্পেশিফিকেশন অনুযায়ী ইউরোপীয় যন্ত্রপাতির পরিবর্তে চায়নায় তৈরি যন্ত্রপাতি এনে অর্থ লোপাটের মহড়া সাজানো হয়।
সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সজিব করপোরেশনকে অর্ধেক মূল্যে পরিশোধ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের চূড়ান্ত পর্ব সারা হয়। ফলে কসাইখানাটি আজ পর্যন্ত চালু করা সম্ভব হয়নি।
একই ঘটনা ঘটেছে কাপ্তানবাজারের কসাইখানা নির্মাণের ক্ষেত্রেও।
এখানেও ইউরোপীয় যন্ত্রপাতির পরিবর্তে স্পেশিফিকেশনবহির্ভূত চীনা যন্ত্রপাতি আনা হয় এবং স্থাপনের আগেই ২৫ কোটি ৪১ লাখ ৭৪ হাজার ৬৬৫ টাকার অর্ধেক একই সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সজিব করপোরেশনকে পরিশোধ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। আজ পর্যন্ত কসাইখানাটি চালু করা সম্ভব হয়নি।
মহাপরিকল্পনা তৈরির নামে সাতত্য নামের একপি প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হরেও মহা তো দূরের কথা, আদৌ কোনো পরিকল্পনাই প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে, পুরো টাকাটাই পকেটে চলে গেছে।
এমনি করে পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের বর্জ্য অপসারণ কাজে বরাদ্দের ৫১ কোটি টাকা নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এরপরও লুটেরারা থেমে থাকেনি।
আরও অতিরিক্ত ২২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা আত্মসাতের ছক সাজানো হয়েছিল। কিন্তু জানাজানি হয়ে গেলে সেই অর্থ আর ছাড় করা হয়নি।
এতসব আত্মসাৎ নাটক যখন একের পর এক মঞ্চস্থ হচ্ছে, তখন মাতুয়াইল সেনেটারি ল্যান্ডফির প্রকল্পের সীমানা প্রাচীরের কাজ না করেই ভৌতিক বিল তৈরি করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স ৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে নেয়।
পরে তদন্তে এটি প্রমাণিত হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি লিখিতভাবে এই ভুয়া বিল উত্তোলনের বিষয়টি স্বীকার করে নেয় এবং পরবর্তীতে কাজটি সম্পন্ন করে দেওয়ার মুচলেকা প্রদান করে।
তবে প্রকল্প পরিচালক উত্তোলিত ওই টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ঠিকাদারকে বারংবার তাগাদা দিলেও আজো এ টাকা ডিএসসিসির তহবিলে জমা হয়নি।
অনুসন্ধান চালিয়ে রূপালী বাংলাদেশ জানতে পেরেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সাবেক আওয়ামী সরকারের সময়ের লুটেরা চক্রটির দাপুটে তৎপরতা লক্ষ্য যায়।
মূলত সেই সময়ে গড়ে ওঠা শক্তিশালী লুটপাট সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণেই এখন ডিএসসিসি। মেয়ররা বিদায় নিয়েছেন, প্রশাসক এসেছে কিন্তু সেই সিন্ডিকেট এখনো বহাল তবিয়তে।
সিন্ডিকেটের নেপথ্য নেতৃত্বে রয়েছেন, স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ (অ: দা:) সিরাজুল ইসলাম। ডিএসসিসিতে তার চাকরিই অনিয়মের মাধ্যমে নেওয়া এবং অনিয়মের মাধ্যমেই তার চাকরিকাল ২১ বছর অতিবাহিত হয়েছে।
কিন্তু তার বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে রূপালী বাংলাদেশে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তার কিছুই হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, আর্থিকসহ নানা উপঢৌকনের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতনদের ম্যানেজ করে এই সিরাজুল ইসলাম বরাবরই চেয়ার রক্ষার পাশাপাশি সীমাহীন দুর্নীতিকে জায়েজ করেছেন।
মহাপরিকল্পনা তৈরির নামে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও স্মার্ট ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপনের নামে ৩৮ কোটি টাকা আত্মসাৎসহ ডিএসসিসির নানা অনিয়মের নেপথ্য নায়ক তিনি।
এ ছাড়াও অনুসন্ধানে লুটেরা চক্রের আরও যাদের নাম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) কাজী বোরহানউদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আনিসুর রহমান এবং অঞ্চল-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মিথুন চন্দ্র শীল প্রমুখ।
সংস্থাটির যান্ত্রিক বিভাগের প্রকৌশলী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সাবেক মেয়র তাপসের আস্কারাতে তার দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগগুলো বরাবরই ফ্রিজ হয়ে থাকে।
কাজী বোরহানউদ্দিন এবং মিথুন চন্দ্র শীলের বহু দুর্নীতি হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, সম্প্রতি ডিএসসিসির বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর নানা অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে।
এসব অনিয়মের তদন্তের জন্য সংস্থাটিকে একাধিকবার পত্র মারফত তাগাদা দেওয়া হলেও কোনো কাজই হয়নি। বরং উল্টো তাদের হাতেই অর্পিত হয়েছে বড় বড় প্রকল্পের দায়িত্ব।
গত বছরে ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের আগেই দেশ ছাড়েন ব্যারিস্টার তাপস। এরপর থেকেই পল্টি দেওয়ার চেষ্টা করেন অভিযুক্ত প্রকৌশলী ও অন্যরা।
এসব বিষয়ে ডিএসসিসির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে তারপর বলতে পারব।
তবে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. জিল্লুর রহমান রূপালী বাংলাদেশের কাছে বলেছেন, দু-একটি বিষয় আমার কানেও এসেছে। কিন্তু সুর্নিদিষ্টভাবে না আসায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
ঢাকা শহরে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি স্থাপনের নামে ৩৮ কোটি টাকা এবং মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের নামে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ চক্রের সঙ্গে সংস্থার বর্তমান প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামের জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পর্কে সিইও বলেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আমাদের কাছে অভিযোগগুলো সুনির্দিষ্টভাবে এলে আমরা বোর্ড গঠন করে দেব। বোর্ডই তা খতিয়ে দেখবে।
 

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন