চীনের নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতির কারণে জার্মান শিল্প খাতে উদ্বেগ বেড়েছে। দেশটির বহু প্রতিষ্ঠান এখন বেইজিংকে সংবেদনশীল সরবরাহ শৃঙ্খলের তথ্য দিচ্ছে, যা চীন ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করতে বা প্রয়োজনে উৎপাদন বন্ধে ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শনিবার (২৫ অক্টোবর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্লুমবার্গ।
বিষয়টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, জার্মান কোম্পানিগুলো যখন চীনের কাছে বিরল মাটির (রেয়ার আর্থ) খনিজ আমদানির অনুমতি চাইছে, তখন তাদের কাছ থেকে সূক্ষ্ম এবং গোপন বাণিজ্যিক তথ্য চাওয়া হচ্ছে। এই তথ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে উৎপাদন পরিসংখ্যান, খনিজের উৎস, গ্রাহকের নাম এবং এমনকি কারখানার ছবিও। অন্যদিকে, জার্মান সরকার নিজেই এই পরিস্থিতি সম্পর্কে কার্যকর কৌশল নিতে পারছে না।
জার্মান অর্থনীতি মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লুইসা-মারিয়া স্পু এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘চীনের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণকে আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি।’ তিনি জানান, সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলো’ ব্যবহার করছে।
ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব পড়ছে বার্লিনে। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে দীর্ঘদিন ধরে চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে কাজ করছে, চীন এখন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোর সরবরাহ শৃঙ্খলকে চাপের মুখে ফেলছে।
গত এপ্রিল মাসে চালু হওয়া ও অক্টোবর থেকে আরও কঠোর করা নতুন নিয়ম অনুযায়ী, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিরল মাটির খনিজ আমদানির জন্য ছয় মাসের লাইসেন্স নিতে হয়। এর বিনিময়ে তাদেরকে বিস্তারিত ব্যবসায়িক তথ্য জমা দিতে হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রক্রিয়া চীনকে ইউরোপীয় শিল্পের দুর্বলতা শনাক্ত করার সুযোগ দিচ্ছে; যেমন কোন কোম্পানি একক চীনা সরবরাহকারীর ওপর নির্ভরশীল বা কার কাছে মজুত স্বল্প।
মার্কিন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক মেরিকসের প্রধান বিশ্লেষক রেবেকা আরসেসাতি বলেছেন, ‘এই তথ্য চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য একধরনের অস্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। বেইজিং এখন জানছে, ইউরোপীয় শিল্প কোথায় দুর্বল এবং কোথায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব।’
চীনের দাবি, এই নিয়মগুলো ‘বিশ্ব শান্তি রক্ষার’ জন্য এবং ‘সামরিক উদ্দেশ্যে’ খনিজের অপব্যবহার ঠেকানোর লক্ষ্যেই করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, নিয়ন্ত্রণ কঠোর হওয়ায় জার্মান শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
ইউরোপীয় চেম্বার অব কমার্সের হিসাব অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে ১৪১টি রপ্তানি আবেদনের মধ্যে মাত্র ১৯টি অনুমোদিত হয়েছে, ফলে প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
জার্মানিতে বর্তমানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত দ্রুত লাইসেন্স পাচ্ছে, তবে তারাও ভবিষ্যৎ সরবরাহ নিয়ে শঙ্কিত। অনেক কোম্পানি এখন অতিরিক্ত মজুত রাখতেও দ্বিধাগ্রস্ত, কারণ চীন ইঙ্গিত দিয়েছে চাহিদার চেয়ে বেশি অর্ডার দিলে তা ‘সামরিক উদ্দেশ্য’ বা ‘যুক্তরাষ্ট্রে পাচার’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বার্লিন সরকার এখনো পর্যন্ত স্পষ্ট কোনো সমাধান দিতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলেও সাড়া পাচ্ছেন না। প্রধান শিল্প সংগঠন বিডিআই জানিয়েছে, তারা অর্থনীতিমন্ত্রী ক্যাথেরিনা রাইখকে এ বিষয়ে জরুরি চিঠি পাঠিয়েছিল, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মার্জ বলেছেন, ‘চীনের ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের ব্ল্যাকমেইলের ঝুঁকিতে ফেলে। জার্মানির নিরাপত্তা ও প্রতিযোগিতার জন্য সরবরাহ শৃঙ্খলে বৈচিত্র্য আনা জরুরি।’ তবে তিনি স্বীকার করেছেন, বিকল্প উৎসে পণ্য সংগ্রহের খরচ বেশি হওয়ায় পরিবর্তন ততটা সহজ নয়।
বেইজিংয়ের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত সূত্রগুলো জানিয়েছে, চীন এই চাপকে দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা জার্মানির কাছে ইঙ্গিত দিয়েছে যে, যদি বার্লিন উচ্চপ্রযুক্তি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে, তবে কিছু নিয়ম সহজ করা হতে পারে।
ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নও চীনের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে, এবং বিকল্প কাঁচামাল সরবরাহের কৌশল তৈরি করছে। তবে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে, কারণ বেইজিং দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে চায়, যা মার্জ সরকারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করছে।
জার্মান শিল্প এখন এক সংকটময় সময় পার করছে। অর্থাৎ একদিকে সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে সরকারি পদক্ষেপের অনিশ্চয়তা। ইউরোপের প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি শিল্পে এই প্রভাব ক্রমে আরও গভীর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।




সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন