দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বেইজিংয়ে এক বিশাল সেনা কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছে চীন। এতে সর্বাধুনিক স্টেলথ যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ সামরিক শক্তির প্রদর্শনী করা হয়। অত্যন্ত পরিকল্পিত ও বর্ণাঢ্য এ আয়োজনে হাজার হাজার সেনা অংশ নেন। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে।
বুধবার সকালে তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজে সভাপতিত্ব করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিনি চীনের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও কমিউনিস্ট পার্টিরও সর্বোচ্চ নেতা।
কুচকাওয়াজ শুরুর আগে শি জিনপিং বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের শুভেচ্ছা জানান। এর মধ্যে ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। এ ছাড়া আরও ২৬টি দেশের নেতা উপস্থিত ছিলেন, যাদের অধিকাংশই পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের দেশ থেকে এসেছিলেন। এরপর শি চীনা সেনা প্রবীণদের শুভেচ্ছা জানান এবং মূল মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন।
শি জিনপিং তিয়ানআনমেনের ‘গেট অব হেভেনলি পিস’ থেকে কুচকাওয়াজ পর্যবেক্ষণ করেন। প্রায় ১০ হাজার সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘চীন শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের পথেই এগিয়ে যাবে।’
তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের ‘জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিজয়’কে স্মরণ করে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করেননি, যদিও যুদ্ধ শেষ করতে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
শি বলেন, ‘মানবজাতি আবারও শান্তি না যুদ্ধ, সংলাপ না সংঘাত, পারস্পরিক লাভ না শূন্য-সমীকরণ—এই সংকটময় বিকল্পের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চীনা জনগণ সবসময় সঠিক ইতিহাসের পাশে, মানবজাতির অগ্রগতির পাশে থাকবে। শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের পথে অটল থেকে বিশ্বের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মানবজাতির জন্য অভিন্ন ভবিষ্যতের সমাজ গড়ে তুলবে।’
শি জোর দিয়ে বলেন, ‘জাতীয় পুনর্জাগরণের জন্য সেনাবাহিনী এখনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এটি কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম মূলনীতি।’
আল জাজিরার বেইজিং প্রতিনিধি ক্যাটরিনা ইউ বলেন, ‘চীনের মানসিকতায় এবং কমিউনিস্ট পার্টির মনোজগতে এ বিশ্বাস গভীরভাবে প্রোথিত যে গত একশ বছরে বিদেশি শক্তির হাতে চীন বহুবার আক্রান্ত, দমন ও অপমানিত হয়েছে। শি জিনপিং স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন যে, আর কখনো তা ঘটতে দেওয়া হবে না।’
মাও স্যুট পরে শি জিনপিং একটি গাড়িতে দাঁড়িয়ে তিয়ানআনমেন স্কোয়ার ঘুরে সেনাদের অভিবাদন জানান। এরপর শুরু হয় মহাকুচকাওয়াজ, যা বেইজিংয়ের প্রধান সড়ক চাঙআন অ্যাভিনিউ দিয়ে অগ্রসর হয়।
কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত হয় চীনের সর্বাধুনিক অস্ত্রসম্ভার—হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, আর্লি ওয়ার্নিং এয়ারক্রাফট এবং শত্রু বিমানের সিগন্যাল জ্যামিং সিস্টেম। দীর্ঘ-পাল্লার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র, যা পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম, সেগুলোও বিশেষভাবে প্রদর্শন করা হয়। প্রায় ৫০ হাজার দর্শকের সামনে সেনারা কুচকাওয়াজে অংশ নেন।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইয়ান চং বলেন, ‘শি মূলত দেখাতে চাইছেন, তার নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এখন এক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পাশাপাশি এত নেতার উপস্থিতি বার্তা দিচ্ছে যে, চীনকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না এবং বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বা হুমকিকেও তারা ভয় পায় না।’
কুচকাওয়াজের সময় আকাশে চীনা বিমান বাহিনী ফ্লাইপাস্ট প্রদর্শন করে। হেলিকপ্টারগুলো আকাশে ব্যানার উড়ায়, যেখানে লেখা ছিল—‘ন্যায়বিচার বিজয়ী হবে’, ‘শান্তি বিজয়ী হবে’ এবং ‘জনগণ জিতবে’।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে প্রশ্ন তোলেন, শি কি কখনো স্বীকার করবেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বিশাল ভূমিকা রেখেছিল?
তিনি লেখেন, “প্রধান প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্ট শি কি উল্লেখ করবেন সেই বিপুল সহায়তা এবং ‘রক্ত’ যা যুক্তরাষ্ট্র চীনের স্বাধীনতার জন্য দিয়েছিল। অনেক মার্কিনি প্রাণ হারিয়েছে চীনের বিজয় ও গৌরবের যাত্রায়… আমি প্রেসিডেন্ট শি এবং চীনের জনগণকে এ উদযাপনের শুভেচ্ছা জানাই।’