ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বজুড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়তুল্লাহ খামেনিকে উৎখাতের ইচ্ছার কথা একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে নিজেদের সরকার পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অবশ্য ইরানিদের রয়েছে।
১৯৫৩ সালের ওই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা শাহ সরকার টিকেছিল ২৭ বছরের মত। ১৯৭৯ সালের অভ্যুত্থানে তাদের পতন ঘটে, সূচনা হয় ইসলামী শাসনের।
তখনকার ঘটনাক্রমের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
তেলক্ষেত্র
ইরানে ১৯৫৩ সালে যে অভ্যুত্থান হয়, তাতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র। মোসাদ্দেগ ইরানিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। ওই সময় তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কয়েকটি নীতি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। দেশের তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোসাদ্দেগ, যা ছিল তৎকালীন মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারের জন্য বড় ধরনের আঘাত। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর ওই সময় তারা ব্যাপকমাত্রায় নির্ভরশীল ছিল।
স্নায়ুযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়
তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের পদক্ষেপটি ইরানে জনপ্রিয় হিসেবে দেখা হয়। এটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় হিসেবেও বিবেচিত হয় কারো কারো কাছে।
শাহের শাসন জোরদার
১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল, ইরানের রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলবিকে শাহ শাসক হিসেবে ক্ষমতায় বসানো এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জেনারেল ফজলুল্লাহ জাহেদিকে নিয়োগ দেওয়া।
অভ্যুত্থান
অভ্যুত্থানের আগে মার্কিন তদন্ত সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এসআইএস মিলে নানা অপপ্রচার ছড়িয়ে মোসাদ্দেগবিরোধী জনমত উসকে দেয়। ১৯৫৩ সালে সিআইএ ও এসআইএস শাহপন্থি বাহিনীকে সংগঠিত করে এবং মোসাদ্দেগবিরোধী বড় ধরনের বিক্ষোভ আয়োজন করে, যেখানে পরে সেনাবাহিনীও যোগ দেয়।
মার্কিন অর্থ
অভ্যুত্থানের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন জাহেদি। তার সরকার যেন স্থিতিশীলতা অর্জন করে, সেজন্য গোপনে দুই দিনের মধ্যে ৫০ লাখ ডলার সরবরাহ করে সিআইএ, যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন নথিতে প্রমাণিত হয়েছে।
সিআইএর ওই কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কারমিট রুজভেল্ট জুনিয়র, যিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নাতি।
মার্কিন স্বীকারোক্তি
২০১৩ সালে সিআইএর কিছু নথি প্রকাশ পায়, যেখানে প্রথমবারের মতো অভ্যুত্থানে সংস্থাটির ভূমিকার প্রমাণ প্রকাশ্যে আসে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূমিকা ছিল, সেটা সবারই জানা। এর আগে, ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ওই অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে নেন।
ফল হয় উল্টো
মোসাদ্দেগকে উৎখাতের পর যুক্তরাষ্ট্র শাহ পাহলবির প্রতি সমর্থন আরও জোরালো করে। কিন্তু বাইরের হস্তক্ষেপে ইরানিরা ক্রমে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং দশকের পর দশক ধরে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব দানা বাঁধতে থাকে।
ইসলামি বিপ্লব
শাহ যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ওঠেন। কিন্তু গত শতাব্দির সত্তরের দশকের শেষ দিকে লাখ লাখ ইরানি তার শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসেন। তাদের চোখে, শাহ সরকার ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবৈধ। ওই আন্দোলনে ধর্মনিরপেক্ষদের পাশাপাশি ইসলামপন্থিরাও যোগ দেন। ধর্মনিরপেক্ষ বিক্ষোভকারীরা রাজপথে নামেন তার স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করে। আর ইসলামপন্থিরা শাহের ‘আধুনিকায়ন নীতির’ বিরুদ্ধে ছিলেন। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ সরকারের পতন ঘটে। এই বিপ্লব ইরানের পশ্চিমা-সমর্থিত রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়; সূচনা ঘটে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ও ধর্মীয় শাসনের।