ঢাকা শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর, ২০২৫

গ্রেটা থুনবার্গ যেভাবে হয়ে উঠলেন ইসরায়েল বিরোধী

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২৫, ০১:৪৭ পিএম
গ্রেটা থুনবার্গ। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

গ্রেটা থানবার্গ একসময় সবুজ ভবিষ্যতের দাবিতে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে আনেন। পরিবেশ দূষণকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে বহুবার গ্রেপ্তার হন তিনি। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে নৃশংস হামলার পর থেকে থুনবার্গের কণ্ঠ স্পষ্টভাবে ইসরায়েলবিরোধিতায় রূপ নিচ্ছে।

তিনি কেফিয়া পরে, ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে ছবি তোলেন এবং ইসরায়েলকে ‘গণহত্যাকারী রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অপরদিকে, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করে হামাসকে অর্থায়নকারী দেশ কাতারকে তিনি প্রায় উপেক্ষা করেছেন—যদিও এই জ্বালানি পোড়ানো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম প্রধান কারণ, যার বিরুদ্ধে তিনি বছরের পর বছর লড়ে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি গাজাগামী ত্রাণবাহী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা প্রায় ৫০টি নৌযান নিয়ে যাত্রা শুরু করে, যাতে ৪৪টি দেশের প্রায় ৫০০ মানবাধিকার কর্মী অংশ নেন। তবে ফ্লোটিলাটি আন্তর্জাতিক জলসীমায় পৌঁছালে ইসরায়েলি বাহিনী এতে হামলা চালায় এবং অন্তত ৩১৭ জন অধিকারকর্মীকে আটক করে। ইসরায়েল জানায়, একটি জাহাজ ছাড়া বাকি সবগুলো জাহাজই তারা আটক করেছে। আটককৃতদের মধ্যে অন্যতম সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ।

ফিলিস্তিনের পক্ষে ভূমিকা

থুনবার্গ বিভিন্ন বিক্ষোভে ‘ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো’, ‘ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করো’, ‘স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করো’ এমন অনেক মিছিল এবং স্লোগানে অংশগ্রহণ করেছেন। তবে হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির দাবি অথবা ৭ অক্টোবরের হামলার সরাসরি নিন্দা করতে তাকে খুব কমই দেখা গেছে।

২০২৩ সালে দুবাইতে জলবায়ু সম্মেলনে এবং ২০২৪ সালে আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনেও তাকে দেখা যায়নি। অনেকেই বলছেন, তিনি তার জলবায়ু আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে এখন প্রধানত ইসরায়েলবিরোধী প্রচারণায় মনোনিবেশ করেছেন।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয়তা

থুনবার্গ কেবল ইসরায়েল-বিরোধিতাতেই থেমে থাকেননি। তিনি তুরস্কের কুর্দি-অধ্যুষিত অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং পরিবেশ ধ্বংস ও কুর্দি জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন।

তিনি বলেন, ‘অবৈধ বন কাটা, খনির জন্য জমি দখল, ও আগুন এসব কুর্দিদের বিরুদ্ধে আক্রমণের অংশ। এতে শুধু জীববৈচিত্র্যই ধ্বংস হয় না, বরং মানুষও বাস্তুচ্যুত হয়।’

একটি এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্টে তিনি তুরস্ককে সংবিধানে কুর্দিদের অধিকার স্বীকার করতে এবং ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন বন্ধ করার আহ্বান জানান। তিনি অভিযোগ করেন, হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী ন্যায়বিচার ছাড়াই কারাগারে বন্দি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে।

এরপর তিনি পশ্চিম সাহারার স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন জানিয়ে মরক্কোর বিরাগভাজন হন। তিনি পশ্চিম সাহারার পতাকা হাতে ছবি তোলেন এবং বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই সংকট উপেক্ষা করা উচিত নয়।’

তিনি আজারবাইজান সরকারের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নির্মূল’-এর অভিযোগ তোলেন এবং জর্জিয়ার রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও ‘ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র’ রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হন।

ইসরায়েল বিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার

স্টকহোমে নিজের সাপ্তাহিক জলবায়ু ধর্মঘটেও থুনবার্গ এখন ‘ফিলিস্তিনের জন্য ন্যায়বিচার’ ও ‘হলোকাস্ট বন্ধ করো’ প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ান। ডেনমার্কে মারস্ক শিপিং কোম্পানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিষ্ঠানটি তাদের জাহাজে ইসরায়েলে অস্ত্র পরিবহন করছে। এর প্রতিবাদে তিনি কোম্পানির অফিসে ঢুকে কার্যক্রম ব্যাহত করেন এবং প্রায় দুই ডজন বিক্ষোভকারীর সঙ্গে গ্রেপ্তার হন, যদিও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তার ১৪ মিলিয়ন ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ারসহ সামাজিক মাধ্যমে তিনি নিয়মিত ইসরায়েল বিরোধী বার্তা ছড়িয়ে দেন এবং আন্দোলনের ডাক দেন।

পরিচিতি ও উত্থান

থুনবার্গ হলেন অভিনেতা সোয়ান্তে থুনবার্গ ও অপেরা গায়িকা ম্যালেনা আর্নম্যানের কন্যা। ২০১৮ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি সুইডিশ পার্লামেন্টের বাইরে ‘ক্লাইমেটের জন্য স্কুল স্ট্রেইজ’ (জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট) প্ল্যাকার্ড নিয়ে একা দাঁড়ানো শুরু করেন। ধীরে ধীরে হাজার হাজার কিশোর-কিশোরী তাকে অনুসরণ করতে থাকে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তার নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ জলবায়ু মিছিলে অংশ নেয়। নিউইয়র্কে জাতিসংঘে ভাষণ দিতে যাওয়ার জন্য তিনি ট্রান্সআটলান্টিক ফ্লাইটের পরিবর্তে সৌরচালিত নৌকা ব্যবহার করেন। সেই বছর টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব’ ঘোষণা করে।

বিতর্ক ও সমালোচনা

থুনবার্গের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের ফলে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন, তার ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান হামাসের প্রতি একধরনের মৌন সমর্থন প্রকাশ করে। সোশাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে এক ব্যবহারকারী লেখেন, ‘অটিস্টিক শিশুদেরও হামাস হত্যা করেছে। তুমি কিছু বলো না। এটা ইহুদিবিদ্বেষ।’

২০২৩ সালের নভেম্বরে আমস্টারডামে এক পরিবেশ ইভেন্টে একজন দর্শক তার বক্তৃতায় রাজনীতি আনার সমালোচনা করলে, থুনবার্গ বলেন, ‘অধিকৃত ভূখণ্ডে জলবায়ু ন্যায়বিচার নেই।’ দর্শককে জোর করে মঞ্চ থেকে নামানো হয়। অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনি পতাকা উত্তোলন ও রাজনৈতিক স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে।

পরে এক ফিলিস্তিনপন্থি অনুষ্ঠানে তিনি ‘জায়নিজম ধ্বংস করো’ বলে স্লোগান দেন। গলায় কেফিয়া, হাতে ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি আবারও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ তোলেন।

২০২৪ সালের মে মাসে মালমোতে ইউরোভিশন গানে তিনি প্রতিবাদে অংশ নেন এবং গ্রেপ্তার হন। এরপর কোপেনহেগেনেও একই কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আন্দোলনের ক্ষয় ও নেতৃত্বের সংকট

অনেকে মনে করছেন, থুনবার্গের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জলবায়ু আন্দোলনের ঐক্য বিনষ্ট করছে। ‘ফ্রেন্ড ফর ফিচার’ সংগঠনের নেতারাও তার ফিলিস্তিনপন্থি বার্তা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে। সুইডেন, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

ইসরায়েলি তরুণরাও তাকে একজন আদর্শ নেত্রী থেকে ‘অসন্তোষ সৃষ্টিকারী চরিত্র’ হিসেবে দেখছে।

গত দেড় বছরে বিশ্বজুড়ে আর বড় কোনো জলবায়ু বিক্ষোভ দেখা যায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় ফিরলেও আগের মতো কোনো প্রতিবাদ-আন্দোলন চোখে পড়েনি। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যতটা উত্তাল প্রতিবাদ একসময় গড়ে উঠেছিল, এখন তা থমকে গেছে।