অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ওপর দুই বছরের গণহত্যা ইসরায়েলের ভাবমূর্তি গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এই অবস্থায় তথ্য ও প্রচারণার যুদ্ধে জয়ী হতে আমেরিকান প্রভাবশালীদের (ইনফ্লুয়েন্সার ও সেলিব্রিটি) লাখ লাখ ডলার দিচ্ছে দখলদার দেশটি।
বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিশ্লেষণাত্মক ওয়েবসাইট রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফ্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
মার্কিন বিচার বিভাগে দাখিল করা ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট (এফএআরএ) রেকর্ড অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের অর্থ প্রদানের জন্য ইসরায়েল ৯ লাখ ডলার বরাদ্দ করেছে। এই কার্যক্রম পরিচালনা করছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ব্রিজ পার্টনার্স এলএলসি। গত ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেলিব্রিটিদের অর্থ ব্যয় করা শেষে অবশিষ্ঠ আছে আনুমানিক ৫ লাখ ৫২ হাজার ৯৪৬ ডলার।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জার্মানির হাভাস মিডিয়া গ্রুপের মাধ্যমে এই অর্থ পাঠাচ্ছে। পরবর্তীতে অর্থ স্থানান্তর করছে ব্রিজেস পার্টনার্সের কাছে। সংস্থাটি এই অর্থে ‘ইনফ্লুয়েন্সার ক্যাম্পেইন’ চালাচ্ছে। ব্রিজেস পার্টনার্স তাদের নথিতে দাবি করেছে, তাদের কাজের উদ্দেশ্য হলো ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান প্রচার’।
তবে রেকর্ড থেকে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি বাস্তবে ১৪–১৮ জন সেলিব্রিটি নিয়োগ করেছে। তারা ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউব ও থ্রেডসে প্রতি মাসে ২৫–৩০টি ইসরায়েলপন্থী পোস্ট দেবে। ব্রিজেস পার্টনার আশা করছে, জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সেলিব্রিটিরা ৭৫-৯০টি পোস্ট করবেন। প্রতিটি পোস্টের জন্য তাদের দেওয়া হবে ৬ হাজার ১৪৩ থেকে ৭ হাজার ৩৭২ ডলার পর্যন্ত। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘এস্থার প্রকল্প’।
নামের দিক থেকে ডানপন্থী হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ‘প্রজেক্ট এস্থার’-এর সঙ্গে মিলে গেলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন দুই প্রকল্পের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। হেরিটেজের একজন মুখপাত্র রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফ্টকে বলেন, ‘২০২৪ সালের অক্টোবরে ঘোষিত দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট এস্থার ও ব্রিজ পার্টনারের এস্থার প্রজেক্টের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই।’
এই প্রচারাভিযানে কোন কোন সেলিব্রিটি অংশ নিচ্ছেন বা প্রত্যেকে কত ডলার করে পাচ্ছেন, তা জানা যায়নি। এ বিষয়ে জানতে ব্রিজেস পার্টনার্সের কাজের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা হাভাসের কাছে একাধিকবার মন্তব্য জানতে অনুরোধ করা হলেও জবাব দেয়নি। ব্রিজেস পার্টনার্সের প্রতিষ্ঠাতা ইয়ার লেভি ও উরি স্টেইনবার্গ। উভয়েই ৫০ শতাংশ করে শেয়ারের মালিক।
ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটাল হিল এলাকায় ব্যবসায়িক ঠিকানাযোগ্য এই সংস্থাটি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র ইউনিটের সাবেক মেজর নাদাভ শট্রাউচলারকে নিয়োগ করেছে। আইনি পরামর্শের জন্য লেভি ও স্টেইনবার্গ পিলসবারি উইনথ্রপ শ পিটম্যানের কাছে যাচ্ছেন। সংস্থাটি আগে বিতর্কিত ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার নির্মাতা এনএসও গ্রুপের জন্যও কাজ করেছিল। গ্রুপটির নির্মিত স্পাইওয়্যার পেগাসাস বিশ্বব্যাপী কুখ্যাত।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একাধিক সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার ইসরায়েল সফর করেছেন। তবে তাদের এস্থার প্রজেক্টের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না তা স্পষ্ট নয়। গত আগস্টে ‘ইসরায়েল৩৬৫ অ্যাকশন’ গ্রুপ ইনফ্লুয়েন্সারদের একটি সফরের আয়োজন করে, যার আংশিক অর্থায়ন এসেছিল ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৮৬ হাজার ডলারের একটি চুক্তি থেকে।
সফরে অংশ নেওয়া ইনফ্লুয়েন্সার ল্যান্স জনস্টন জানান, ইসরায়েল সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি এখন আরও বেশি সমর্থন করি, এমনকি তাদের অস্ত্র পাঠাতেও রাজি।’ গত শুক্রবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘জেনারেশন জিওন’ নামের একটি গোষ্ঠীর আয়োজনে নিউ ইয়র্ক সিটিতে একদল ইনফ্লুয়েন্সারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর করছিলেন তিনি।
ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে বৈঠকে নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে বলেন, ‘ইসরায়েলের প্রতি ক্রমহ্রাসমান সমর্থন মোকাবেলায় আমাদের পাল্টা লড়াই করতে হবে। আমরা কীভাবে পাল্টা লড়াই করব? আমাদের প্রভাবশালীদের (ইনফ্লুয়েন্সার বা সেলিব্রিটি) মাধ্যমে। আমার মনে হয়, সুযোগ পেলে তাদের সঙ্গেও কথা বলা উচিত। কারণ নেটাগরিকদের কাছে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রকাশিত এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন ডেমোক্র্যাট ভোটারদের বড় অংশই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চায়। এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক মিডিয়া ম্যানেজার ব্র্যাড পার্স্কেলের সঙ্গে ১৫ লাখ ডলারের চুক্তি করেছে ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে ‘কৌশলগত যোগাযোগ’ সেবা দিয়ে ইহুদি-বিরোধিতার মোকাবেলায় সহায়তা করবেন তিনি। পার্স্কেল ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্পের ডিজিটাল মিডিয়া পরিচালক, ২০২০ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় সিনিয়র মিডিয়া (ডেটা ও ডিজিটাল অপারেশন) উপদেষ্টা এবং সর্বশেষ মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তথ্যযুদ্ধে বারবার পিছিয়ে পড়ায় ইসরায়েলি সরকার নিজ দেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি। আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বর্তমান সরকারকে তীব্র সমালোচনা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেন, ইসরায়েলকে ‘একটি কুষ্ঠরোগী রাষ্ট্রে’ পরিণত করা হচ্ছে। তিনি প্রস্তাব দেন দ্রুত, শক্তিশালী ও সমন্বিত একটি নতুন প্রচার সদরদপ্তর গড়ে তুলতে এবং সর্বত্র ইসরায়েলের বন্ধুদের ব্যবহার করতে, যাতে তারা নিয়মিতভাবে ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বকে জানাতে পারে।
বেনেটের ভাষায়, ‘ইসরায়েলকে নতুন গল্প বলতে হবে, শক্তি আর ইতিবাচক পদক্ষেপের গল্প। বর্তমান সরকার সেই সুযোগ হারাচ্ছে, কারণ তারা শুধু ক্ষমতা আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত।’
চুক্তি অনুযায়ী, তাদের জুলাই মাসে ইসরায়েলের পক্ষে পোস্ট শুরু করার কথা ছিল। তবে তারা এখনও বিদেশি এজেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত হয়নি। নাম প্রকাশ না করায় এবং মার্কিন ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের (এফএআএ) আওতায় নিবন্ধন না করায় ইনফ্লুয়েন্সারা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিদেশি লবিং আইনটি লঙ্ঘন করছেন। এফএআরএ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তাদের অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে যে এটি ইসরায়েলের স্পনসর করা কনটেন্ট।
কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ডেমোক্র্যাটাইজিং ফরেন পলিসি প্রোগ্রামের পরিচালক বেন ফ্রিম্যান বলেন, এই ক্ষেত্রে আইন স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘যদি কোনো বিদেশি সরকার আপনাকে তাদের পক্ষে আমেরিকান জনসাধারণকে প্রভাবিত করার জন্য অর্থ প্রদান করে, তবে আপনাকে অবশ্যই এফএআরএ-র আওতায় নিবন্ধন করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি এই ইনফ্লুয়েন্সারা ইসরায়েলি সরকারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে সচেতনভাবে এমন কনটেন্ট তৈরি করে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার বা লাখ লাখ অনুসারী দেখেন, তাহলে কেন তারা এফএআরএ-র অধীনে নিবন্ধিত হবে না, তা বোঝা যায় না।’
জনসমর্থনে ধস
সাম্প্রতিক জরিপগুলো ধারাবাহিকভাবে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন জনসমর্থন দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। শুক্রবার প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, ডেমোক্র্যাট ভোটারদের ৬৫ শতাংশ ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে, ৭২ শতাংশ বিশ্বাস করেন গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে, ৭৫ শতাংশ বিরোধিতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের বার্ষিক অস্ত্রচুক্তি পুনর্নবীকরণের।
এছাড়া ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা মত দিয়েছেন, ইসরায়েলি কর্মকর্তা ও সেনাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা উচিত। ওয়াশিংটনভিত্তিক ফিলিস্তিনি অধিকারকেন্দ্রিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ আইএমইইউ পলিসি প্রজেক্ট এবং যুব-নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল সংস্থা জেন-জেড ফর চেঞ্জের হয়ে এই জরিপটি পরিচালনা করেছে ইউগভ। এতে অংশ নিয়েছিলেন ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রাথমিক ভোটে অংশগ্রহণকারী এক হাজারের বেশি সম্ভাব্য ভোটার।