ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০২৫

ট্রাক নয়, যেন চলন্ত চিত্রশালা!

এপি
প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০২৫, ০৬:২৪ পিএম
পাকিস্তানি ট্রাক শিল্প ভারী পরিবহণকে মোবাইল মাস্টারপিসে পরিণত করেছে। ছবি- এপি

পাকিস্তানের ধুলোময় মহাসড়ক আর ব্যস্ত শহরের রাস্তায় ট্রাকগুলো গর্জন করছে, যেন রঙ, কবিতা আর নকশায় মোড়ানো একেকটি চলন্ত ক্যানভাস। এসব ভারী যানবাহন কেবল পরিবহণের উপকরণ নয়, বরং দেশের লোকসংস্কৃতির এক জীবন্ত প্রদর্শনী।

এই ট্রাক শিল্পের শিকড় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন মালিকরা তাদের যানবাহনগুলোকে জটিল ফুলের নকশা, ক্যালিগ্রাফি এবং সাংস্কৃতিক মোটিফ দিয়ে সাজাতে শুরু করেছিলেন।

পাকিস্তানি ট্রাক শিল্প ভারী পরিবহণকে মোবাইল মাস্টারপিসে পরিণত করেছে। ছবি- এপি 

শুরুটা হয়েছিল সাধারণ অলঙ্করণের মাধ্যমে, কিন্তু ধীরে ধীরে তা এক অনন্য শিল্পকলায় রূপ নিয়েছে। চিত্রশিল্পী, ওয়েল্ডার, ইলেকট্রিশিয়ান ও ধাতুশিল্পীরা মিলে প্রতিটি ট্রাককে গর্বের প্রতীক ও আঞ্চলিক পরিচয়ের বাহক হিসেবে তৈরি করেন।

বেলুচিস্তানে উটের হাড়ের খোদাই, পেশোয়ারে সূক্ষ্ম কাঠের কাজ, আর রাওয়ালপিন্ডিতে থাকে রঙিন ডিস্কো-স্টাইলের নকশা সব মিলিয়ে প্রতিটি ট্রাক হয়ে ওঠে একটি শিল্পকর্ম।

পাকিস্তানি ট্রাক শিল্প ভারী পরিবহণকে মোবাইল মাস্টারপিসে পরিণত করেছে। ছবি- এপি 

রাওয়ালপিন্ডির ৫৫ বছর বয়সি মুহাম্মদ আশফাক এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় চার দশক ধরে। তিনি ট্রাক রং করাকেই নিজের জীবনের কাজ ও গর্ব বলে মনে করেন।

আশফাক বলেন, ‘প্রতিটি ক্লায়েন্টের নিজস্ব রুচি ও বাজেট থাকে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করি, তারা কোন স্টাইল চান—পেশোয়ার, হাজারা, সোয়াত, পিন্ডি, মান্ডি বাহাউদ্দিন নাকি করাচি?’

পাকিস্তানি ট্রাক শিল্প ভারী পরিবহণকে মোবাইল মাস্টারপিসে পরিণত করেছে। ছবি- এপি 

এর মধ্যে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ধারা হিসেবে ধরা হয় ‘পিন্ডি স্টাইল’-কে। এর বৈশিষ্ট্য হলো উজ্জ্বল রং, বড় বড় স্টিকার, আয়নার কাজ এবং ঘন স্তরে সাজানো নকশার উপাদান।

ট্রাকচালক ফারুখ সানা বলেন, ‘পিন্ডি স্টাইল মানে একে বিয়ের কনের মতো সাজানো।’ সম্প্রতি তিনি নিজের ট্রাকটি এই স্টাইলে সাজিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যখন মানুষ আমাদের ট্রাকের প্রশংসা করে, তখন সত্যিই ভালো লাগে। এটা আমাদের পরিশ্রম আর শিল্পসৌন্দর্যের প্রতীক।’

পাকিস্তানি ট্রাক শিল্প ভারী পরিবহণকে মোবাইল মাস্টারপিসে পরিণত করেছে। ছবি- এপি 

স্টাইল, রং, জটিলতা, উপকরণ ও খরচ অনুযায়ী প্রতিটি ট্রাকের সাজ ভিন্ন হয়ে থাকে।

একটি ট্রাক পুরোপুরি সংস্কার করতে ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা (প্রায় ৭ হাজার থেকে ১৭ হাজার ৭৯০ মার্কিন ডলার) পর্যন্ত খরচ হতে পারে। এই খরচ মূলত ব্যবহৃত উপকরণ এবং টায়ার ও চ্যাসিসের মতো প্রধান যন্ত্রাংশ বদলানো হয়েছে কি না তার ওপর নির্ভর করে।

তবে শুধু বাহারি সাজসজ্জাই নয়, প্রতিটি ট্রাকে থাকে কবিতা, ধর্মীয় বার্তা কিংবা চালকের ব্যক্তিগত স্লোগান, যা চালকের রুচি, আবেগ ও রসবোধের প্রতিফলন।

পাকিস্তানি ট্রাক শিল্প ভারী পরিবহণকে মোবাইল মাস্টারপিসে পরিণত করেছে। ছবি- এপি 

এই ট্রাকশিল্প এখন শুধু পণ্যবাহী যানেই সীমাবদ্ধ নয়। রিকশা, বাস এমনকি ঘর সাজানোর জিনিসেও এর ছাপ পড়েছে।

১৯৭০-এর দশকে এই শিল্প প্রথম আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যখন বিদেশি পর্যটকরা এই ব্যতিক্রমী রঙিন ট্রাকগুলোর ছবি তুলতে শুরু করেন। তারপর থেকে এই শিল্প আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে জায়গা করে নিয়েছে এবং সমসাময়িক ফ্যাশন ও পণ্যের নকশাতেও প্রভাব ফেলেছে।

পাকিস্তানি ট্রাক শিল্প ভারী পরিবহণকে মোবাইল মাস্টারপিসে পরিণত করেছে। ছবি- এপি 

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এই দক্ষিণ এশীয় ঐতিহ্য আজও টিকে আছে। আশফাকের মতো কারিগররা আন্তরিকভাবে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, আর ফারুখ সানার মতো চালকেরা তাদের ট্রাককে শুধু জীবিকার মাধ্যম নয়, বরং চলমান সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে দেখেন।

সানা গর্ব করে বলেন, ‘প্রতিটি চালকেরই স্বপ্ন থাকে তার ট্রাককে সবচেয়ে আলাদা করে তোলার। যখন আমরা রাস্তায় ট্রাক চালাই আর মানুষ ঘুরে তাকায়, তখন বুঝি আমরা সত্যিই কিছু বিশেষ কিছু তৈরি করেছি।’