২০২২ সালের খরার সময় লন্ডনে পানির তীব্র সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। জলাধারের পানি দ্রুত কমে যাওয়া এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাওয়ায় পানি সরবরাহকারী কোম্পানি ও সরকার বৃষ্টির জন্য মরিয়া হয়ে প্রার্থনা করেছিল।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর পানির ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল; হোটেলের সুইমিংপুল খালি রাখা, পুকুর শুকিয়ে যাওয়া, অফিসে পরিচ্ছন্নতা না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি গড়ায়। যদি খরা আরও এক বছর স্থায়ী হতো, তবে শহরের কল শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
এটি ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন এক চিত্রের ইঙ্গিত মাত্র। গত মঙ্গলবার ব্রিটিশ সরকার ইংল্যান্ডে ‘জাতীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য’ পানি সংকট ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ শুষ্ক আবহাওয়া চলতে থাকলে গোটা দেশ পানিশূন্য হয়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যেই পাইপ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আগামী মাসগুলোতে আরও বিধিনিষেধ আরোপের সম্ভাবনা রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউকে সেন্টার ফর ইকোলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজি সতর্ক করেছে যে, নদীর প্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে কম এবং জলাধার ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
খরা সাধারণত দুই বছর স্থায়ী হয়। এক বছরের শুষ্ক আবহাওয়া মানে পানির মজুদ শেষ হয়ে যাওয়া, যা এখন ঘটছে। যদি আগামী বছরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত না হয় তবে ঘাটতি তীব্র হবে। কৃষকরা সেচ দিতে অক্ষম হবে, পরিবার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর বিধিনিষেধ মানতে হবে। জলাধারের পানি ইতোমধ্যেই রেকর্ড পরিমাণ কম এবং নদীর প্রবাহ অত্যন্ত দুর্বল। ফলে ইংল্যান্ড বৃষ্টির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
পূর্বাভাস বলছে, ২০৫৫ সালের মধ্যে প্রতিদিন ৫ বিলিয়ন লিটার পানির ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা বর্তমানে দেশের মোট সরবরাহের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। এতে অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। থিঙ্কট্যাঙ্ক পাবলিক ফার্স্ট অনুমান করছে, সংকট মোকাবিলা না করা গেলে এই সংসদ মেয়াদে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে ৮.৫ বিলিয়ন পাউন্ড।
প্রশ্ন উঠছে, বৃষ্টির জন্য বিখ্যাত ইংল্যান্ড কীভাবে এ পরিস্থিতিতে পড়ল?
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ শিলাস্তর নরম ও ছিদ্রযুক্ত চক দিয়ে গঠিত, যা বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ করে বিশাল জলাধারে জমা রাখে। এখানকার অধিকাংশ পানীয় জলের উৎস এই ভূগর্ভস্থ জলস্তর। অন্যদিকে উত্তরে শক্ত শিলা থাকলেও বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় জলাধারগুলো পূর্ণ থাকত। নদীগুলোও অতীতে স্থায়ী পানি সরবরাহ করত। ইউরোপের অন্যতম বৃষ্টিপ্রবণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও পানি সংকট আজ বাস্তবতা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির চাহিদা ক্রমবর্ধমান। কিন্তু গত ৩০ বছরে একটি নতুন জলাধারও তৈরি হয়নি। বর্তমানে ইংল্যান্ডের জলাধারগুলো গড়ে মাত্র ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশ পূর্ণ, যা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। ইউকেসিইএইচ-এর হাইড্রোক্লাইমেটোলজিস্ট ড. উইলসন চ্যানের মতে, পানি সরবরাহ স্থিতিশীল করতে কয়েক মাস ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত প্রয়োজন।
একইসঙ্গে অব্যবস্থাপনাও পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের পানি কোম্পানিগুলো প্রতি বছর লিকেজে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন লিটার পানি অপচয় করছে। অনুমান করা হয়, মোট পরিশোধিত পানির প্রায় ২০ শতাংশ এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। পানি কোম্পানিগুলো ২০৫০ সালের মধ্যে লিকেজ অর্ধেক কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও, বার্ষিক পাইপ প্রতিস্থাপনের হার মাত্র ০.০৫ শতাংশ। লন্ডনের বহু পয়ঃনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক এখনো ১৯ শতকে নির্মিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
১৯৮৯ সালে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন খাতের বেসরকারিকরণও সমালোচিত হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, গ্রাহকদের বিল থেকে সংগৃহীত অর্থ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহার না করে কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ প্রদানে ব্যয় করেছে। এ ছাড়া একচেটিয়া বেসরকারি নিয়ন্ত্রণ গ্রাহক বিল কমানোর ওপর জোর দিয়েছে, বিনিয়োগের বদলে।
সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় পানি কোম্পানিগুলোকে কঠোরভাবে খরা পরিকল্পনা অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। পানিমন্ত্রী এমা হার্ডি সতর্ক করে বলেছেন, বিলম্ব হলে কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহি করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হোসপাইপ নিষেধাজ্ঞা গ্রাহকের অসন্তুষ্টি বাড়ায়, তাই কোম্পানিগুলো প্রায়শই তা এড়িয়ে চলে। ফলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে অনিরাপদ মাত্রায় পানি উত্তোলন চলছে, যা বৃষ্টিপাতে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে না।
এখন বিভিন্ন সমাধান নিয়ে আলোচনা চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতের জন্য নতুন জলাধার নির্মাণ, প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান যেমন জলাভূমি পুনরুদ্ধার, নদীর ধারে বৃক্ষরোপণ এবং বৃষ্টির পানি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলাতে হবে। পরিবারগুলোকে পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে— যেমন গোসলের সময় কমানো, পানি সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা এবং স্মার্ট ওয়াটার মিটার চালু করা। কৃষকদেরও নিজস্ব জলাধার তৈরি ও টেকসই পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
ওয়াটারওয়াইজের মতে, গোসলের সময় মাত্র এক মিনিট কমালেই পানি সাশ্রয় সম্ভব। গ্রিন বিল্ডিং গ্রুপগুলো বলছে, পানি সাশ্রয়ী শাওয়ার হেড ব্যবহার করাও কার্যকর উপায়। আর সরকার-নিযুক্ত এক প্রতিবেদনে প্রস্তাব করা হয়েছে, সারা দেশে স্মার্ট ওয়াটার মিটার বসানো উচিত, যাতে যারা স্প্রিংকলার চালায় বা সুইমিং পুল ভরাট করে, তাদের খরচ বেশি হয় আর যারা মিতব্যয়ী, তারা কম বিল দেয়।
ইএ-এর পানি পরিচালক ও ন্যাশনাল ড্রট গ্রুপের চেয়ারম্যান হেলেন ওয়েকহ্যাক বলেন, ‘সবাইকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং আমাদের পাানিসম্পদের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করতে হবে। পানি কোম্পানিগুলোকে দ্রুত লিকেজ মেরামত করতে হবে এবং পানি সাশ্রয়ে পথ দেখাতে হবে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের গতি দ্রুত হওয়ায় বৃষ্টিপাতের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। সাবেক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা স্যার ডেভিড কিং বলেছেন, ইংল্যান্ডে খরা এখন সতর্কতা নয়, এটি জলবায়ু পতনের সুস্পষ্ট প্রমাণ। এর মোকাবিলায় জলচক্র পুনর্গঠন, প্রকৃতিতে বিনিয়োগ এবং প্রতিটি ফোঁটা পানির কার্যকর ব্যবহারের বিকল্প নেই।
কৃষকরা চাইলে সেচের চাপ কমাতে নিজেদের জমিতে জলাধার তৈরি করতে পারেন। পাশাপাশি প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানও কাজে লাগানো যায়, যেমন ছোট বাঁধ তৈরি করা, পানি ধরে রাখার জন্য বিভার ছেড়ে দেওয়া বা শুকিয়ে যাওয়া জলাভূমি পুনরুদ্ধার করা।
রিভারস ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী মার্ক লয়েড বলেন, ‘আমাদের নদী ও জলাধার এলাকায় প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে এমন স্বাস্থ্যকর মাটি তৈরি করা যা পানি শোষণ করবে, নদীর ধারে গাছ লাগিয়ে ছায়া দেবে এবং প্রবাহ ধীর করবে, জলাভূমি গড়ে তুলে পানি জমিয়ে ধীরে ধীরে ছেড়ে দেওয়া, আর নদী পুনর্গঠন করে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর বাড়ানো ও দূষণ কমানো।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে সম্ভব, পানীয় জলের বদলে বৃষ্টির জল ব্যবহার করা উচিত, যেমন গাড়ি ধোয়া, বাগান করা, পোষা প্রাণী গোসল করানো, ছোট পুল ভরাট করা বা টয়লেট ফ্লাশে। অনেক জলসংকটগ্রস্ত দেশ বহু বছর ধরেই এভাবে করছে, আমাদেরও এখন সেই পথে হাঁটা দরকার।’
সংকট কেবল যুক্তরাজ্যের নয়। ইউরোপের প্রায় অর্ধেক অঞ্চল খরার কবলে, দক্ষিণ ইউরোপের কৃষি হুমকির মুখে এবং আফ্রিকার বহু দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ায়, যুক্তরাজ্যের জন্য এটি সতর্কবার্তা। ২০৫০ সালের মধ্যে নয়টি নতুন জলাধার নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও, অনেকের মতে তা অপ্রতুল এবং দেরিতে গৃহীত উদ্যোগ।