দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে গতকাল রোববার বিকেল থেকে তিন দফায় বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও তার পূর্ববর্তী প্রস্তুতিমূলক কর্মপরিকল্পনা এবং দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এ বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে, বিলম্ব হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন নিয়ে বিএনপি এই আশ^াসের বাণী শোনালেও জামায়াত ও এনসিপির নেতারা জানালেন নানা শঙ্কা আর উদ্বেগের কথা। চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে এত বড় নির্বাচন (জাতীয় সংসদ) পরিচালনা করবে, সেই প্রশ্ন সামনে এনেছে জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পাটি (এনসিপি) বরাবরের মতোই জুলাই সনদের আইনি এবং সাংবিধানিক ভিত্তির জন্য আগে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করার বিষয়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে দলটি। এদিকে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দল নানা মত দিলেও প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রেসসচিব শফিকুল আলম। বৈঠক শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ভাবেন, তা জাতির জন্য হবে গভীর বিপজ্জনক।
গতকাল বোরবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার রাষ্ট্রীয় বাসভবনে প্রথমে জামায়াত, এরপর এনসিপি এবং সর্বশেষ বিএনপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন।
নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে, বিলম্ব হওয়ার কোনো সুযোগ নেই- মির্জা ফখরুল নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে, বিলম্ব হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে বলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমাদের আশঙ্কা নির্বাচনকে বিলম্বিত করার লক্ষ্যে একটি চক্রান্ত কাজ করছে। তবে আশঙ্কা করার কারণ নেই। নির্বাচন কমিশন যে সিডিউল ঘোষণা করেছে, সেই সময়ই নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সে কথাই বলেছেন।’
বৈঠকে গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, এটা একটি গর্হিত কাজ এবং উদ্বেগজনক। গভীরভাবে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার কথা বলেছি।’
লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে দেশের স্বার্থে যেকোনো দলের প্রধানের সঙ্গে বসার। এটা একান্ত তার ব্যক্তিগত এখতিয়ার।
জামায়াত ও এনসিপি জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধ দাবি করলেও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, রাজনীতি ইস্যুতে কোনো কথা হয়নি।
সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় প্রবেশ করে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আব্দুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
সরকার কীভাবে নির্বাচন করবে, শঙ্কিত জামায়াত: বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের সাংবাদিকদের বলেন, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে এত বড় নির্বাচন (জাতীয় সংসদ) পরিচালনা করবে, তা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী শঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন। আগে একদল বাসস্ট্যান্ড দখলে নিত, এখন আরেকটি গ্রুপ নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে দখলদারদের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।
বৈঠক শেষে জামায়াতের চার সদস্যের প্রতিনিধি দলে নেত্বত্ব দেন সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আযাদ।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, এখন যে সময় আছে, সরকার যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সঠিক উদ্যোগ নেয়, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব। পরিস্থিতির যদি উন্নতি ঘটে, তাহলে একটা নির্বাচন হওয়া সম্ভব।
জামায়াতের এ নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারা একমত পোষণ করেছেন, তবে কার্যকারিতার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, দেশ একটি নীলনকশার নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সরকারের লন্ডনে একটি দলের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিল, যা নজিরবিহীন ঘটনা। এতে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হয়েছে এবং একটি দলকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের দিনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করাটা কোনো একটা চাপে পড়ে করা হয়েছে। এখানে একটা চাপ আছে। সরকারের উচিত ছিল জুলাই সনদের ব্যাপারে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং তারিখ ঘোষণা করা।
জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, নুরুল হকের (গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি) ওপর হামলার ষড়যন্ত্র অনেক গভীরে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে বলেছে জামায়াত। আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টি কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, জাতীয় পার্টির বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন তারা।
গণপরিষদ নির্বাচন চায় এনসিপি:
জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করার বিষয়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে আহ্বান জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের ১ বছর হয়ে যাওয়ার পরেও আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি, যারা আহত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসন, চিকিৎসা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। আমরা কিছু দিন আগে দেখেছি শহীদ পরিবাররা তাদের দাবিতে মাঠে নামলে সেখানে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং বেশ কিছু শহিদ পরিবারের সদস্যরা আহত হন। আমরা সরকারের কাছে শহিদ পরিবার এবং আহত সহযোদ্ধা যারা আছেন, তাদের পুনর্বাসন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আহ্বান জানিয়েছি।’
এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে একটি গুম কমিশন করা হয়েছে। গতকালকে (শনিবার) আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ছিল এবং সেই গুম কমিশন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, সেসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে আমরা সরকারের কাছে সুস্পষ্টভাবে দাবি করেছি, সরকার গুম কমিশনের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে রাষ্ট্রীয় যেসব সংস্থার সদস্যরা এ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত, তাদের বিষয়ে যেন সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নেয়।’
আদিব আরও বলেন, ‘একই সঙ্গে আমরা আশঙ্কা করছি, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে যে নির্বাচনগুলো হয়েছিল, দেখেছিলাম রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করত। গণপরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের দীর্ঘ ৫৫ বা ৫৪ বছরের যে রাজনৈতিক সংকট, একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে স্বৈরাচারী মনোভাব কিংবা কাঠামো গড়ে উঠছে, তার স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। আগামী নির্বাচন যেন গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার কথা বলেছি।’
আরিফুল ইসলাম আদীব আরও বলেন, ইসির পক্ষ থেকে একটি কথা বলা হয়েছে যে ৩১ অক্টোবরে যাদের বয়স ১৮ হবে, শুধু তারা ভোট দিতে পারবে। তার মানে আগামী ছয় মাস পরে যে নির্বাচন হবে ওই দিনও যদি কারো বয়স ১৮ হয়, সে কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। পরিস্থিতিতে আমাদের এ গণঅভ্যুত্থানে তরুণদের সরাসরি সক্রিয় যে অংশগ্রহণ করেছিল, সেই জায়গা থেকে আমরা মনে করি, এটিকে আরেকটু নমনীয় হয়ে ফেব্রুয়ারিতে যাদের ১৮ বছর পূর্ণ হবে, তারাও যেন সরাসরি নির্বাচন অংশগ্রহণ করতে পারে, সেই জায়গা যেন আমলে নেওয়া হয়।’
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন, স্পষ্ট বার্তা দিলেন প্রধান উপদেষ্টা:
প্রেস সচিব আগামী জাতীয় নির্বাচন ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠকে এ বার্তা দেন প্রধান উপদেষ্টা। গতকাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বৈঠকে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রধান উপদেষ্টা আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, জাতির উদ্দেশ্যে তার দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের যে সময় ঘোষণা করেছেন, সেই সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে জাতীয় নির্বাচন হবে। সব দলকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
শফিকুল আলম আরও জানান, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ভাবেন, তা জাতির জন্য হবে গভীর বিপজ্জনক। বৈঠকের মাঝে ঐকমত্য কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ জুলাই সনদ নিয়ে অগ্রগতি জানিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
শফিকুল আলম আরও বলেন, দুর্গাপূজা ঘিরে কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশ যাতে কেউ সৃষ্টি না করতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। জাতীয় পার্টি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য প্রধান উপদেষ্টা শুনেছেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন