বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মাইনুল হক ভূঁইয়া

প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২৫, ১২:৩৭ এএম

গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন

সরকারি সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষমতা হারাচ্ছে গৃহায়ন ও রাজউক

মাইনুল হক ভূঁইয়া

প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২৫, ১২:৩৭ এএম

সরকারি সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষমতা  হারাচ্ছে গৃহায়ন ও রাজউক

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার উন্নয়নকৃত আবাসিক প্লট বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরের দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে সরকার। গত ৯ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন করে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগ। পরিবর্তন অনুযায়ী, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি আবাসিক প্লট, ফ্ল্যাট ও স্পেস হস্তান্তর এবং রেজিস্ট্রির ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে সাব-রেজিস্ট্রাররা। এই ক্ষমতা আগে গৃহায়ন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) হাতে ছিল। এ ছাড়া নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী প্লট, ফ্ল্যাট ও স্পেস হস্তান্তর এবং রেজিস্ট্রির ক্ষমতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসিল্যান্ডদের হাতেও যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি রাজউক ও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে সরকারের দুই কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে না চাইলেও তাদের মাঝে চাপা অসন্তোষ বিরাজ করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, দলিলের সত্যতা যাচাইয়ের সক্ষমতা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নেই। ফলে নকল দলিল দিয়ে মালিকানা পরিবর্তনের প্রবণতা বাড়বে। এর ফাঁক-ফোকরে বিশেষ করে প্রবাসীদের সম্পত্তি হুমকির মুখে পড়বে। এদিকে বিভিন্ন এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ হতাশা ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। তা ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কাছেও অভিযোগ করেছেন বলে জানা গেছে। প্রজ্ঞাপনে ৭ দফা প্রস্তাবনা ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ থেকে  সরকারি আবাসন প্রকল্পগুলোর বিক্রয়, দান, হেবা বা বণ্টন দলিল সম্পাদন বা বাতিল, আমমোক্তার দলিল সম্পাদন বা বাতিল এবং ঋণ গ্রহণের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান প্রথা বাতিল বলে গণ্য হবে। একই তারিখ থেকে এসব কার্যক্রমের জন্য তপশিলে বর্ণিত আবাসিক প্লট ও ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন গ্রহণের প্রয়োজন হবে না। তবে লিজ দলিলের অন্যান্য শর্ত যেমন : কোনো প্লটের বিভাজন বা একাধিক প্লটের একত্রীকরণের মাধ্যমে প্লটের আয়তন পরিবর্তন অর্থাৎ মাস্টার প্ল্যানের কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি গ্রহণের বর্তমান পদ্ধতি বহাল থাকবে।

উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ওয়ান-ইলেভেন সরকার এমন একটি বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন করলেও পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার জনস্বার্থবিরোধী ও বৈষম্যমূলক সেই আইন বাতিল করে। সরকারি সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ক্ষমতা ফের মন্ত্রণালয়ের কাছে অর্পিত  হয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবর খিলগাঁও এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে পাঠানো অভিযোগপত্রের বরাতে জানা যায়, বিগত ১৬ থেকে ১৭ বছরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার নিজ দল এবং অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীসহ দাপুটে মন্ত্রী-এমপি, স্থায়ী কমিটির সদস্য ও তাদের আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে রাজউক এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কয়েকশ প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়। যার বর্তমান বাজারমূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এই প্লট, ফ্ল্যাট বা জমি বরাদ্দের সাথে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জড়িত। এই কর্মকর্তা পতিত সরকারের আমলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্বে  ছিলেন। সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হওয়ায় তাকে প্রাইজ পোস্টিং হিসেবে একটি প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু সর্ষের মধ্যেই ভূত। এই প্রকল্পের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। দুর্নীতির দায়ে তার পদোন্নতি স্থগিত করা হয়।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রাজউক, গৃহায়ন এবং পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত জমি, প্লট বা ফ্ল্যাটের মালিকানা পরিবর্তন বা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত শুনানি বা হাজিরার বিধান চালু রয়েছে। পতিত সরকারের দোসরদের বরাদ্দকৃত জমি, প্লট বা ফ্ল্যাটের মালিকানা সহজে এবং নির্বিঘেœ পরিবর্তন বা হস্তান্তরের জন্যই একের পর এক প্রয়াস চালায় সিন্ডিকেটটি। এর ফলেই সাম্প্রতিক এই পরিবর্তন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানার জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলামের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

খিলগাঁও এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক নজরুল ইসলাম বলেন, সিন্ডিকেটটির যোগসাজশে সরকারি সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষমতা রাজউক ও গৃহায়ন থকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তন বা হস্তান্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সরাসরি সাব-রেজিস্ট্রার এবং এসি ল্যান্ডের হাতে। যেখানে সরকারি সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তন ও হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কোনোরকম যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ থাকছে না। ব্যক্তিমালিকানা সম্পত্তির ন্যায় কেনা-বেচা করা যাবে ওইসব সরকারি সম্পত্তি। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক সরকারের সুবিধাপ্রাপ্ত এসব ব্যক্তি ও তাদের আত্মীয়স্বজন অনেকেই এই মুহূর্তে পলাতক রয়েছেন। যেহেতু তাদের এসব সম্পত্তির বেচা-বিক্রি করতে হলে রাজউক, গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি প্রয়োজন হবেÑ ব্যক্তিগত হাজিরার প্রয়োজন হবে, তাই তাদের সম্পত্তি কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই বেচা-বিক্রির পথ সুগম হবে। এই সম্পত্তির বেচা-বিক্রির টাকার বড় একটা অংশ চলে যাবে দেশের বাইরে।

রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে জানা যায়, ধানমন্ডি এলাকার বেশ কয়েকটি সরকারি প্লট বা বাড়ি সাবেক ওরিয়েন্টাল লি. বর্তমানে ইবনেসিনা হাসপাতালের দখলে রয়েছে। এসব প্লট বা বাড়ির মূল্য হাজার কোটি টাকারও বেশি। দীর্ঘ ৫০ থেকে ৬০ বছর যাবত এসব সম্পত্তি তাদের দখলে রয়েছে। কিন্তু মালিকানার সপক্ষে নেই কোনো সঠিক দলিল বা কাগজপত্র। অভিযোগ আছে, ভুয়া দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে যুগের পর যুগ ধরে আত্মসাৎ করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এসব সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের মূল বাধা হচ্ছে পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পূর্বানুমতি নেওয়া। মূল মালিক না থাকায় এবং মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমতি না থাকায় হাজারো চেষ্টা-তদবির করেও এসব সম্পত্তি নিজের নামে নিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

এখন মন্ত্রণালয় থেকে এসব সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তন বা হস্তান্তরে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দিতে যাচ্ছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এসব সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তন বা হস্তান্তরের সম্পূর্ণ ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে সাব-রেজিস্ট্রার ও এসিল্যান্ড। ফলে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় হারাতে যাচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি। এতে একদিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেমন শত শত কোটির টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ শত শত কর্মকর্তা ও কর্মচারী বেতন-বোনাস সংকটে পড়বে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৯-৬০ সালের দিকে সরকার ঢাকা মহানগরীকে আধুনিক ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৩টি এল.এ. কেসের মাধ্যমে এই এলাকায় ব্যক্তিমালিকানা জমি হুকুম দখল করে। ফলে গড়ে তোলা হয় খিলগাঁও বিশ্ব রোড, কমলাপুর রেলস্টেশন, রেলওয়ে ডকইয়ার্ড এবং রেললাইন। পরবর্তীতে সরকার ভূমি হুকুম দখলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকার মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে অ্যাওয়ার্ড লিস্ট অনুযায়ী। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তাদের ওয়ারিশদের নামে প্লট বরাদ্দ কার্যক্রম শুরু করে ১৯৬৮-৬৯ সাল থেকে। ভূমি স্বল্পতার কারণে সব ক্ষতিগ্রস্ত অ্যাওয়ার্ডিকে একসাথে প্লট বরাদ্দ দিয়ে পুনর্বাসিত করা সম্ভব হয়নি। প্লট বরাদ্দের কার্যক্রম এখনো চলমান।

আশির দশকের দিকে বরাদ্দকৃত এসব প্লটের লিজ বা ইজারা দলিল সম্পাদনের কার্যক্রম শুরু করে পূর্ত মন্ত্রণালয়। এখনো বহু প্লট মালিক প্লট বরাদ্দ পেলেও ইজারা দলিল সম্পাদন করতে পারেননি। গত ৫ আগস্টের পর এসব ক্ষতিগ্রস্তকে বরাদ্দকৃত প্লটের লিজ দলিল সম্পাদনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় পূর্ত মন্ত্রণালয়। ফলে অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন শত শত নিরীহ ক্ষতিগ্রস্ত প্লট মালিক।

ভুক্তভোগী মোজাম্মেল হক বলেন, দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত এবং হয়রানিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সাব-রেজিস্ট্রি ও এসিল্যান্ড অফিস অন্যতম। সেখানে প্লট মালিকদের হয়রানি আরও বহুগুণে বাড়বে। তার মতে, সরকারি এসব জমি-প্লটের দায়িত্ব সরকার তথা মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকায় কেউ নিয়মের বাইরে সরকারি রাস্তা-জমি দখল করে বাড়িঘর নির্মাণের সাহস পায়নি। এমনকি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকার পরও প্রভাবশালী বাড়ির মালিক এবং ডেভেলপার রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে যাচ্ছেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুমতি গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকায় তারা এসব বাড়ি-ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে পারছেন। এসব সম্পত্তির দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের হাত থেকে ছেড়ে দেওয়া হলে এমন সুন্দর একটি আবাসিক এলাকা অচিরেই পুরান ঢাকার মতো এক ঘিঞ্জিময় হয়ে উঠবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!