বৃক্ষাশ্রম। বৃক্ষ পুনর্বাসনকেন্দ্র। ভাগ্য বিড়ম্বিত ও আহত গাছেদের অনন্য এক সংগ্রহশালা। বরগুনার সদর উপজেলার খাকদন নদী ও বিষখালীর মোহনায় বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে দেশের প্রথম ও একমাত্র বৃক্ষ পুনর্বাসনকেন্দ্র। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বনের পাশে আরেকটি উপবন তৈরি করে বানানো হয়েছে পাখিদের অভয়ারণ্য। প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো করে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণকেন্দ্র। ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দর্শনার্থীদের নজর কেড়েছে প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্র ‘সুরঞ্জনা ইকো ট্যুরিজম অ্যান্ড রিসোর্ট’।
‘আপনার শিশুর প্রথম পাঠশালা হোক প্রকৃতি’Ñ সুরঞ্জনা ইকো ট্যুরিজম অ্যান্ড রিসোর্টের প্রবেশপথেই এমন একটি ফলক প্রকৃতিপ্রেমীদের মনোজগতে ভিন্ন বার্তা দিয়ে যায়। জমি বিক্রি, ভবন সংস্কার, সড়ক সম্প্রসারণ অথবা ঝড়ের কবলে পড়ে জীবন বিপন্ন হওয়া অর্ধশতাধিক বয়স্ক গাছের আশ্রয় মিলেছে এখানে। অনেকেই সময় করে দেখতে আসছেন স্মৃতিবিজড়িত সেসব গাছেদের।
শুধু বৃক্ষ পুনর্বাসনকেন্দ্র নয়, প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটনশিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে ‘প্রাণ প্রকৃতির পাঠশালা’ স্লোগান নিয়ে এ রিসোর্টটিতে গড়ে তোলা হয়েছে পাখিদের অভয়ারণ্য। বিলুপ্তপ্রায় ৫০ প্রজাতির এক হাজারেরও বেশি ফলদ বৃক্ষের বাগান রয়েছে এখানে। যার সবই পাখিদের জন্য উৎসর্গিত। তাই এখানকার শত শত দেশীয় প্রজাতির পাখির পাকা পেঁপে ও কলাসহ বিভিন্ন ফল খাওয়ার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন দর্শনার্থীরা। এসব কারণে দিন দিন এখানে যেমন বাড়ছে দর্শনার্থীর ভিড়, তেমনি বাড়ছে পাখিদের সংখ্যাও।
বরগুনার একজন স্থানীয় বাসিন্দা ও পটুয়াখালী জেলার সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রোকসানা পারভিন বেঞ্জু বলেন, ‘বাড়িতে নতুন ভবন তৈরি করার কারণে বাবা-মায়ের হাতে লাগানো বেশ কিছু বড় গাছ অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেটে ফেলা জরুরি হয়ে পড়েছিল। সুরঞ্জনা সে সমস্যার সমাধান দিয়েছে। সুরঞ্জনার বৃক্ষাশ্রমে সেসব গাছ দিয়ে দিয়েছি আমরা। সেখানে গাছগুলো অনেক ভালো আছে। সময় করে মাঝে মাঝেই আমরা সেসব গাছেদের সঙ্গে দেখা করতে যাই।’
বরগুনার প্রবীণ চিকিৎসক ডা. মনিজা বলেন, ‘শহরের বাড়ির জমি বিক্রি করে বাকি অংশে নতুন ভবন নির্মাণের কারণে অনেক বড় গাছ কেটে ফেলার প্রয়োজন পড়ে। অথচ সেসব বৃক্ষকে জড়িয়ে আমাদের ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি। এমন পরিস্থিতিতে সুরঞ্জনা ইকো ট্যুরিজম অ্যান্ড রিসোর্ট সমস্যার সমাধান দিয়েছে। বিশেষ কৌশলে সেসব বৃক্ষ তুলে নিয়ে সুরঞ্জনার বৃক্ষাশ্রমে সেসব গাছ লাগানো হয়েছে। সুরঞ্জনায় ঘুরতে গিয়ে সেসব গাছেদের নিয়মিত দেখা হয়। সুরঞ্জনার এ উদ্যোগকে কার্যকর ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বলে মনে করি।’
স্থানীয় বৃক্ষপ্রেমী, পরিবেশকর্মী এবং উন্নয়নকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি স্টেকহোল্ডাররাও এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। এর আগে বৃক্ষ ও পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে রোপণকারী যে-ই হোক, ১৮ বছরের আগে কোনো গাছ কাটার নিষেধাজ্ঞার নতুন আইন প্রণয়নের দাবিতে সরকারের বন বিভাগ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে আবেদন জানানো হয়েছে সুরঞ্জনা ইকোট্যুরিজম অ্যান্ড রিসোর্টের পক্ষ থেকে।
সুরঞ্জনা ইকোট্যুরিজম অ্যান্ড রিসোর্টের উদ্যোক্তা সোহেল হাফিজ বলেন, ‘উপকূলীয় জেলা বরগুনা একদিকে ঘূর্ণিঝড়প্রবণ, অন্যদিকে নদীভাঙনকবলিত জেলা। এ জেলায় প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড় এবং নদীভাঙনের কবলে পড়ে শত শত বৃক্ষ হয় কাটা পড়ে, না হয় নদীগর্ভে হারিয়ে যায়। এ ছাড়া নগর উন্নয়ন, সড়ক সংস্কার কিংবা জমি বিক্রি বা ভবন সংস্কারের কারণে দীর্ঘদিনের স্মৃতিবিজড়িত অনেক বড় গাছ কেটে ফেলতে হয় প্রায়শই। এ ক্ষেত্রে সেসব গাছ তুলে নিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রোপণ করা হয় সুরঞ্জনায়। ভাগ্য বিড়ম্বিত এমন অর্ধশতাধিক বৃক্ষ রয়েছে সুরঞ্জনায়।’
সোহেল হাফিজ আরও জানান, ‘এসব ভাগ্য বিড়ম্বিত গাছ সংরক্ষণে সরকারের কোনো কর্মসূচি বা প্রকল্প নেই। অথচ এমন সব বৃক্ষদের বিশেষ প্রক্রিয়ায় তুলে এনে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের প্রাঙ্গণে অথবা বৃক্ষশূণ্য কোন সড়কে রোপন করা হলে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন রক্ষা হতো, তেমনি বৃদ্ধি পেত সৌন্দর্য।’
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. আলমগীর কবীর বলেন, ‘বরগুনার সুরঞ্জনা ইকো ট্যুরিজম অ্যান্ড রিসোর্টের ব্যতিক্রমী এ বৃক্ষাশ্রম বা বৃক্ষ পুনর্বাসন কেন্দ্রটি বৃক্ষপ্রেমীদের মাঝে নতুন এক ভাবনার সৃষ্টি করেছে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এবং নদীভাঙনকবলিত এলাকার বৃক্ষ সংরক্ষণে এমন উদ্যোগ যেমন ব্যতিক্রমী, তেমনি কার্যকর। দেশের প্রতিটি জেলায়ই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এমন উদ্যোগ থাকা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাল, খেজুর, গাব, কাঠবাদাম, ডেউয়া, কাউফলসহ সুরঞ্জনায় বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির সহস্রাধিক বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি পাখ-পাখালির জন্য একটি অভয়াশ্রম সৃষ্টি করেছে। দেশের সব ইকো ট্যুরিজম অ্যান্ড রিসোর্টের জন্য সুরঞ্জনার এ উদ্যোগ অনুসরণীয় হতে পারে।’
এ বিষয়ে বরগুনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ‘প্রকৃতিভিত্তিক ইকো ট্যুরিজম অ্যান্ড রিসোর্টের বৃক্ষ পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং পাখিদের অভয়াশ্রমসহ সৃজনশীল নানাবিধ কার্যক্রম ইতিমধ্যেই দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখানে দর্শনার্থীরা আসছেন। পাশপাশি নারী ও শিশুসহ স্থানীয় এলাকাবাসীরও একটি নির্মল বিনোদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বরগুনার পর্যটনশিল্পের পরিচিতিও ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। শুরু থেকেই এ উদ্যোগের পেছনে বরগুনা জেলা প্রশাসন নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছে। ভবিষতেও এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’
এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মিস তাছলিমা আক্তার বলেন, সুরঞ্জনা ইকো ট্যুরিজম অ্যান্ড রিসোর্টের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ‘বৃক্ষ পুনর্বাসন কেন্দ্রের’ কথা শুনেছি। শিগগিরই সেখানে পরিদর্শনে যাব। এ উদ্যোগ সামনে এগিয়ে নিতে বিধি অনুয়ায়ী সম্ভব সব রকমের সহযোগিতা করা হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন