ক্যালেন্ডারে এখন অগ্রহায়ণ। হেমন্তের গায়ে ধানের গন্ধ, বাতাসে হিমের স্পর্শ, আর ভোরের কুয়াশায় ঢেকে থাকা গ্রাম-বাংলার পথ; সব মিলেই যেন শীতের প্রথম ডাক। আর শীত মানেই এক টুকরো উষ্ণতার খোঁজ। ঠিক এখানেই এসে জায়গা করে নেয় শাল। শুধু শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নয়, বাঙালি নারীর ব্যক্তিত্ব ও রুচিকে আরও বর্ণময় করে তুলতে শাল একটি অপরিহার্য উপাদান। ফ্যাশন ও ঐতিহ্যের মিশেলে শালের ব্যবহার এখন জীবনেরই একটি অংশ। শালের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। মুঘল আমলে ঐশ্বর্য ও রুচির প্রতীক হয়ে ছিল পশমিনা শাল। সম্রাট আকবরের রাজসভায় যে পশমিনা শাল ব্যবহৃত হতো, তার মূল্য ছিল একেকটা জমিদারি
সমান। হাতে তৈরি সেই শিল্পকর্মে থাকত সূচিকর্ম, জরি, রুপালি সুতা ও পাহাড়ি পশম, যা একটি শালকে পরিণত করত শিল্পসম্ভারে।
১৮শ শতকে কাশ্মীরি শালের প্রতি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের উন্মাদনা। নেপোলিয়নের স্ত্রী জোসেফিন কাশ্মীরি শাল সংগ্রহের জন্য ছিলেন বিখ্যাত। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ ফ্রান্সের অভিজাত নারীদের ফ্যাশনে নতুন ধারা তৈরি করে। বাংলায় শালের ব্যবহার শুরু হয় মূলত নবাবীয় আমলে। ঢাকাই নবাববাড়ি, উত্তরবঙ্গের জমিদার পরিবার বা কলকাতার অভিজাত সমাজে শাল ছিল শীতের অপরিহার্য অংশ। পূজার আসর, বিয়ের দিন, বা ঠান্ডা সন্ধ্যায় এক টুকরো শাল গায়ে জড়িয়ে সেই সময়ের নারী-পুরুষরা প্রকাশ করতেন তাদের সৌন্দর্য ও অবস্থান। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ আমলে শাল হয়ে ওঠে বিয়ের উপহার, সম্মাননা, এমনকি স্মৃতিচিহ্ন।
বর্তমানে এসেও ঠিক একই রকমভাবে শালের ব্যবহার দেখা যায়, তবে যুগে যুগে বদলেছে শালের ধরন।
শালের যত ধরন
অতীতে শালের রূপ ও ধরন নিয়ে সীমাবদ্ধতা থাকলেও বর্তমানে আর কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। বিভিন্ন উপাদান, বুনন, রঙ ও ডিজাইনের ভিত্তিতে শাল এখন শতভাগ বৈচিত্র্যময়।
পশমিনা শাল
পশমিনা শাল অতি আরামদায়ক উষ্ণতা ও নান্দনিক কারুকাজের মেলবন্ধনে তৈরি হয়। সাধারণত অভিজাত শ্রেণির আলাদা দৃষ্টি থাকে পশমিনা শালের দিকে। দেহাবরণটির প্রধান উপাদান পশমিনার নমনীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য এর রয়েছে জগৎ জোড়া খ্যাতি। কাপড়টি বোনা হয় চাংথাং মালভূমিতে চড়ে বেড়ানো চাংথাঙ্গি নামক পাহাড়ি ছাগলের পশম থেকে। দাম তুলনামূলক বেশি হলেও এর আভিজাত্য ও মূল্য এখনো অনস্বীকার্য।
উলের শাল
সবচেয়ে সাধারণ ও কার্যকর শালের মধ্যে উলের শাল অন্যতম। রঙের বৈচিত্র্য, পাতলা বা মোটা উভয় ধরনের হওয়াতে বাঙালিদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় এ শাল।
জামদানি শাল
জামদানি শাড়ির খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। শাড়ির মতো জামদানি শালের খ্যাতিও কম নয়, হালকা ও নরম এ শালে থাকে নিপুণ বোনা কারুকাজ, যা বাংলার সৌন্দর্য তুলে ধরে। সাধারণরত উঁচু বংশের মানুষের কাছে এ শাল জনপ্রিয়।
অন্যান্য
পশমিনা, উল, জামদানি শাল ছাড়াও বাংলাদেশে নানা ধরনের শাল পাওয়া যায়। যার মধ্যে কাশ্মীরি কারুকাজ শাল, যেখানে হাতে করা ফুলেল নকশা, আড়ি ও টিলির কাজ থাকে। জরির শাল, সাধারণত বিয়ের সাজ এবং বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য, যা সোনালি-রুপালি কাজ, পাথর ও মিরর ওয়ার্ক দিয়ে তৈরি হয় থাকে। এ ছাড়াও অরগাঞ্জা, সিল্ক, মসলিন, শিফন বা ডিজিটাল প্রিন্ট শালের প্রচলণ রয়েছে। যা বাঙালিদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
যুগে যুগে ট্রেন্ড
শালের ফ্যাশন স্থির নয়, সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে তার ব্যবহারের ভাষা। ৭০-৮০ দশকে বাংলা সিনেমার নায়িকাদের গায়ে জড়ানো ভেলভেট বা ফুলেল উলের শাল, ৯০ দশকে শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পাতলা সিল্ক শালের প্রচলন বাড়ে। ২০০০-এর পর আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও ফ্যাশন প্রভাব শালের ভোক্তাদের রুচিকে আরও বহুমাত্রিক করে তোলে। ডিজিটাল প্রিন্ট, হ্যান্ডলুম, ব্লক, অ্যাপ্লিক, কাশ্মীরি ও কাঞ্চিপুরম স্টাইলের শাল এখন ট্রেন্ডের অংশ। আজকাল তরুণীরা শাল গলায়, কাঁধে বা স্টোল হিসেবে ব্যবহার করছে।

