বিশ্ববাজারে গমের দাম নিম্নমুখী। দেশেও পর্যাপ্ত আমদানি হয়েছে। সরকারি হিসাবে এই মুহূর্তে দেশে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন গম মজুত আছে। অথচ কোনো কারণ ছাড়াই পাইকারি বাজারে বাড়ছে খাদ্যপণ্যটির দাম। মাত্র ১৫ দিনে মণপ্রতি দাম বেড়েছে ২০০ টাকারও বেশি। সে কারণে বিক্রি হওয়া গমের সরবরাহও কমিয়ে দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে গমের বাজার।
একই সঙ্গে গমের বাজারে পুরোনো সিন্ডিকেট আবারও সচল হয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়ছে আটা-ময়দার খুচরা বাজারেও। এতে সমস্যায় পড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। কারণ মূল্যবৃদ্ধির এই ভার তাদের বইতে হবে।
ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, গমের লেনদেন হয় খুবই সীমিত আকারে। ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) ব্যবসায়ীরা মূলত ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসও (সরবরাহ আদেশ) সংগ্রহ করে ফ্লাওয়ার মিলমালিকদের কাছে সরবরাহ করেন। দীর্ঘদিন ধরে এসও বিক্রি করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। জুলাইয়ের শেষ দিকেও প্রতিদিন স্বাভাবিক নিয়মে গম সরবরাহ দেওয়া হয় এ প্রক্রিয়ায়। তবে এখন দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রির রসিদ দিয়ে গুদামে গাড়ি পাঠানো হলেও গম দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। উল্টো সিরিয়াল দেওয়া হচ্ছে। সে অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে মিলছে গম। দেরিতে সরবরাহের কারণে গমের বাজার চড়ছে বলে ট্রেডিং ও এসও লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ।
দেশে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের লেনদেনের ক্ষেত্রে অনুমোদিত পদ্ধতি এসও। আমদানিকারকের বিক্রি করা এসও একটি নির্দিষ্ট সময় পর সরবরাহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিক্রির সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যে মিল কিংবা গুদাম থেকে পণ্য সংগ্রহের নিয়ম থাকলেও লোকসানে থাকা এসওগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাজারে হাতবদল হতে থাকে। তবে বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে মিল কিংবা গুদামে পণ্য সংগ্রহের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। ওই সময় সরবরাহ পাওয়া না গেলে ঊর্ধ্বমুখী বাজার আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাশিয়া থেকে আমদানি হওয়া গমের দাম মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) এক সপ্তাহ আগেও ছিল ১ হাজার ৩২০ থেকে ১ হাজার ৩৩০ টাকা। গতকাল মঙ্গলবার তা বেড়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫৪০ টাকায় লেনদেন হয়। কানাডা থেকে আমদানি হওয়া গম একই সময়ে মণপ্রতি ১২০-১৩০ টাকা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৬২০ থেকে ১ হাজার ৬২৫ টাকায়। যদিও গমের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চলতি বাজেটে ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নতুন করে এআইটি ও টার্নওভার ট্যাক্স বৃদ্ধিকে দায়ী করেছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘বিশ্ববাজারে গমের দাম স্থিতিশীল রয়েছে এটা সত্য। কিন্তু জুলাই থেকে প্রতিটি আলাদা আলাদা ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে নতুন করে ২ শতাংশ এআইটি আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া পণ্যের টার্নওভার ট্যাক্স শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকা গমের বাজার সে কারণে জুলাই-পরবর্তী সময়ে কিছুটা বেড়েছে।’ এতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছুই করার নেই বলে তিনি মনে করেন।
কুমিল্লার লাকসামের নশরতপুরে অবস্থিত প্যাসিফিক কনসিউমার গুডস লিমিটেডের স্বত্বাধীকারী শাহাদাত হোসেন আলী মুরাদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার জানামতে বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ গম আছে। কিছু স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা ব্যক্তি অতিমাত্রায় মুনাফার লোভে বাজারে একধরনের সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজার অস্থিতিশীল করে রেখেছে। আমি বা আমরা এই অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসও কেনার পর মিলগেট কিংবা নির্দিষ্ট গুদাম থেকে যেকোনো সময় পণ্য উত্তোলনের সুবিধা পান ব্যবসায়ীরা। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলা সেই নিয়ম ভেঙে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো হঠাৎই সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। মূলত গমের দাম বাড়ায় এমনটা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ওয়্যারহাউজে গাড়ি পাঠানোর পর ফেরত দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। এতে যুক্ত হচ্ছে গাড়ির ভাড়াসহ বাড়তি খরচ।
এ প্রসঙ্গে খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ দিচ্ছে না। গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসও বিক্রি করে টাকা উঠিয়ে নিলেও প্রয়োজনের সময় গম সরবরাহ না দেওয়ায় বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছেন শত শত ব্যবসায়ী। এ কারণে পাইকারি বাজারে গমের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। ফলে আটা-ময়দার বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।’
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মোতালেব হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বাজারে গমের চাহিদা আছে। কিন্তু এলসি শিপমেন্ট পিছিয়ে যাওয়ায় সরবরাহ কমেছে। এতে গমের দাম বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাতুনগঞ্জের এক গম ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে গমের দাম নিম্নমুখী। তাই দেশের বাজারেও দাম কম হওয়ার কথা। কিন্তু চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজসহ অন্য ভোগ্যপণ্যের বাজার যেভাবে তদারকি করা হয়, সেভাবে গমের বাজার তদারকি করা হয় না। তাই আমাদের দেশে দাম বেশি।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাশেম ফ্লাওয়ার মিলের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশের বাজারে গমের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। একই সঙ্গে বিশ^বাজারে দামও নি¤œমুখী। সিন্ডিকেট করে আমদানিকারকেরা ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন। এতে প্রতিদিনই বাড়ছে গমের দাম। ঢাকার কারওয়ান বাজারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, বিশেষ একটি গ্রুপ বাজার সরগরম করতে কলকাঠি নাড়ছে। তারা সিন্ডিকেট করে মুনাফা লুটতে চায়। এতে সমস্যায় পড়ছে নি¤œ আয়ের মানুষ। কারণ মূল্যবৃদ্ধির এই ভার তাদের বইতে হবে।
এদিকে দেশে গমের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকায় এরই মধ্যে আটা-ময়দার দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা ও প্যাকেটজাত আটা-ময়দার দাম মানভেদে কেজিপ্রতি বেড়েছে ৫ টাকা পর্যন্ত। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন পর সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার ময়দার দাম বেড়েছে। আগে কেজিপ্রতি প্যাকেটজাত ময়দা ৬৫-৭০ টাকায় লেনদেন হলেও বর্তমানে তা ৭৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এ ছাড়া খোলা ময়দা কেজিপ্রতি সর্বনি¤œ ৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪০-৪৫ টাকায় এবং প্যাকেট আটা ৫০-৫৫ টাকায়। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘বিশ্ববাজারে গমের দাম নি¤œমুখী। তা হলে আমাদের দেশে গমের দাম কমার কথা। বাজার তদারকির ব্যবস্থা জোরদার নেই বলে এমনটা হচ্ছে।
বিশ^বাজারে পাঁচ বছরে সর্বনিম্নে গমের দাম
উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোয় ফসল সংগ্রহের মৌসুম চলায় বাজারে গমের সরবরাহ বেড়েছে। এ কারণে পাঁচ বছরে সর্বনিম্নে নেমেছে খাদ্যশস্যটির দাম। এমন প্রেক্ষাপটে শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) ভবিষ্যৎ সরবরাহ চুক্তিতে গমের দাম তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। এদিন সয়াবিন ও ভুট্টার দামও কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ফসলের স্বাস্থ্যকর অবস্থা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় উৎপাদন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হওয়ায় এসব কৃষিপণ্যের বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহের চাপ তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিশ্ববাজারে গমের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকায় ক্রমাগত দাম কমছে। বিশ্বের প্রধান খাদ্যশস্যগুলোর মধ্যে গম একটি। বাজারসংশ্লিষ্টরা বর্তমানে আগামী কয়েক সপ্তাহের ফসল সংগ্রহের গতি-প্রকৃতি ও বৈশ্বিক রপ্তানি প্রবণতার দিকে নজর রাখছেন, যদি উৎপাদন ও মজুত বাড়তে থাকে, তাহলে দাম আরও নিম্নমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকেরা।
পর্যাপ্ত মজুত সরকারি হিসাবে
সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন গম মজুত আছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সরকারি খাতে গম আমদানির উৎস বহুমুখীকরণের কার্যক্রম চলমান। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রসহ আর্জেন্টিনা, বুলগেরিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করা হয়েছে। চলতি ২০২৫ সালে আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরকারি খাতে গম আমদানির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন