ডা. এইচবিএম ইকবাল। ছিলেন ঢাকার ত্রাস। আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়ে হয়েছিলেন সংসদ সদস্য। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় ব্যাংকের অনুমোদন নেন। দি প্রিমিয়ার চেয়ারম্যান হয়ে ব্যাংকের কাছে নিজের ভবন ভাড়া দিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। টানা ২৫ বছর ব্যাংকটির নেতৃত্বে থেকে কর্মীদের মারধরসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনেক নির্দেশনাকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। তার স্ত্রী, ছেলেসহ পরিবারের একাধিক সদস্য ছিলেন পরিচালনা পর্ষদে। ইকবালের সন্তানদের একজন হয়েছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান, অপরজন চেয়ারম্যান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও প্রিমিয়ার ব্যাংকে সংঘটিত অনিয়মের বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশে পাচার করেছেন তিনি।
জানা যায়, ২০০১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চারদলীয় জোট হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করলে তা রাজধানীর মালিবাগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ এমপি ইকবালের নেতৃত্বে বের হওয়া মিছিলের মুখোমুখি হয়। এ সময় ডা. ইকবালের নেতৃত্বাধীন মিছিল থেকে বিএনপির মিছিলে গুলি চালানো হলে চার বিএনপি কর্মী নিহত হন। ওই ঘটনায় পত্রিকায় ছাপা হওয়া ছবিতে গোলাগুলির সময় ইকবালের ছবি স্পষ্ট দেখা যায়। ওই ছবি নিয়ে মালিবাগ এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় পোস্টারিং করতে দেখা যায়। এ নিয়ে দায়ের করা মামলায় ২০০২ সালের ২৯ ডিসেম্বর ইকবালসহ ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট ওই মামলায় এইচবিএম ইকবালসহ ১৬ জন আসামিকে খালাস দেন আদালত। এতকিছুর পরও তিনি একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কথিত রয়েছে, শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় ক্ষমতা বাড়তে থাকে ইকবালের। তৎকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট ও ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মালিবাগ মোড়ে চারজনকে গুলি করে হত্যার মামলা থেকে আওয়ামী লীগের সাবেক দুই সংসদ সদস্য ডা. ইকবাল ও নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনসহ ১৫ জনকে অব্যাহতি দেন।
জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে প্রিমিয়ার ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে এইচবিএম ইকবাল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দেন আওয়ামী লীগের সাবেক এই সংসদ সদস্য। তখন তার ছেলে ও ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান মঈন ইকবালও পদত্যাগ করেন। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানের পাশাপাশি তারা পরিচালক পদও ছেড়ে দেন। তবে ব্যাংকটিতে তার আরেক ছেলে মোহাম্মদ ইমরান ইকবাল চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। গত ১৯ আগস্ট প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন পর্ষদে একজন শেয়ারধারী পরিচালক ও পাঁচজন স্বতন্ত্র পরিচালক বসানো হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মুখে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ ছাড়ে ইকবাল ও তার স্ত্রী। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ইকবালের দুই স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শিল্পী ও প্রয়াত মমতাজ বেগম, দুই ছেলে মঈন ও ইমরান এবং মেয়ে নওরিনের হিসাব জব্দ করে। তবে সেই নির্দেশনা অমান্য করে তার জব্দ হিসাব থেকে টাকা তোলার সুযোগ দিতে বাধ্য হয় প্রিমিয়ার ব্যাংক। এ জন্য ওই ব্যাংককেই আবার ১ কোটি ১১ লাখ এবং ৩০ হাজার ডলারের সমপরিমাণ (প্রায় ৩৬ লাখ ৯০ হাজার) টাকা জরিমানা গুনতে হয়।
ভবন ভাড়ায় ভয়াবহ জালিয়াতি
গত বছরের শেষদিকে প্রিমিয়ার ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে উঠে আসে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের নামে থাকা ভবন ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত হারে ভাড়া দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য। পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কার্যক্রম বনানীর ইকবাল টাওয়ারের ১৯টি ভাড়া করা ফ্লোরে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান কার্যালয়ের জন্য আলোচ্য ভবনের ব্যবহার অনুপযোগী ও অসম্পূর্ণ ২০ ও ২১তম দুটি ফ্লোরের মোট ১৪ হাজার বর্গফুট ভাড়া গ্রহণ করার পর থেকে আগস্ট-২০২৪ পর্যন্ত ৪২ মাসের ভাড়া ও সার্ভিস চার্জ বাবদ সর্বমোট ২৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ভবন কর্তৃপক্ষকে প্রদান করা হয়। অথচ ফ্লোর দুটিতে শুধু ছাদ রয়েছে। আজ পর্যন্ত ফ্লোর দুটির দেয়াল, বৈদ্যুতিক কাজ, ফ্লোর ফিনিশিং, স্যানিটারি কাজ, ড্রেসার ফিনিশিং ও টাইলস বসানো ইত্যাদি কোনো কাজই সম্পন্ন করা হয়নি। অর্থাৎ ভাড়া গ্রহণ করার সময় ফ্লোর দুটি ভাড়া প্রদানের উপযোগী না থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালকের ব্যক্তি স্বার্থে তথ্য গোপন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
এ ভাড়াকৃত ভবনের প্রতিটি ফ্লোরের ভাড়া চুক্তিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, চুক্তিপত্র অনুযায়ী ভবনটির প্রতি বর্গফুটের মাসিক ভাড়া ৪৪০ থেকে ৪৬২ টাকা পর্যন্ত; যা পাশাপাশি অন্যান্য ভবনের ভাড়ার চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি। তা ছাড়া কোনো প্রকার সার্ভিস না নিয়েও প্রতি বর্গফুটে ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা করে সার্ভিস চার্জ প্রদান করা হচ্ছে। তা ছাড়া এত বিপুল পরিমাণ সার্ভিস চার্জ প্রদান করা সত্ত্বেও সার্ভিস চার্জের অতিরিক্ত বিধিবহির্ভূতভাবে প্রতি মাসে জেনারেটর বাবদ প্রতি বর্গফুটে ২.৩০ টাকা, সার্ভিস চার্জ (পরিষ্কার+নিরাপত্তা অন্যান্য) বাবদ প্রতি বর্গফুটে ১ টাকা, লিফট বাবদ প্রতি বর্গফুটে ২.৬০ টাকা ও গ্যাস বিল বাবদ মাসিক ৯০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও বনানী শাখার জন্য ‘ইকবাল সেন্টার’-এর বিভিন্ন ফ্লোরের ভাড়ার বিপরীতে ভাড়া চুক্তি অনুযায়ী মোট ১৯৭.১৯ কোটি টাকা অগ্রিম প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতি মাসের ভাড়া থেকে অগ্রিম সমন্বয়ের পর ৩১-১২-২০২৩ তারিখে মোট বকেয়া অগ্রিমের পরিমাণ ১৫৯.৩২ কোটি টাকা থাকার কথা থাকলেও ব্যাংকের খতিয়ান মোতাবেক অগ্রিম বাবদ মোট বকেয়া স্থিতি ২২০.৪৭ কোটি টাকা।
অর্থাৎ চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অধিক অগ্রিম প্রদান করা হয়েছে অথবা ইতঃপূর্বে প্রদত্ত অগ্রিম সম্পূর্ণ সমন্বয় না করে নতুন ভাড়া চুক্তির সময় অগ্রিম প্রদান করা হয়; যা প্রদেয় অগ্রিম অপেক্ষা বেশি। এ ছাড়া ব্যাংকের নিজস্ব জমি কেনা হলেও সেখানে কোনো ভবন করা হচ্ছে না। ধারণা করা হয়, চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং চেয়ারম্যানের কন্যার মালিকানাধীন ভবন ব্যাংকের কাছে অযৌক্তিক ভাড়া দিয়ে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্যই নিজস্ব জমিতে কোনো ভবন তৈরি করতে আগ্রহ দেখায়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ব্যাংকটির সেন্ট্রাল গোডাউনের জন্য ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান মঈন ইকবালের মালিকানাধীন জমিতে ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা উচ্চহারে (প্রতি বর্গফুট ১২৫ টাকা) ভাড়া না নিয়ে বনানীতে নিজস্ব জমিতে যে স্থাপনা রয়েছে, তা অনায়াসে গোডাউনের জন্য ব্যবহার করা যায় বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের চারটি নতুন শাখা খোলার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃক ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন ও অন্যান্য খাতে ব্যয়ের পরিমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) নির্দেশনায় বর্ণিত নতুন শাখা স্থাপনের প্রতি বর্গফুটের জন্য ১ হাজার ৮৫০ টাকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমা মানা হয়নি। এমনকি শাখা খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিজস্ব ক্রয় নীতিমালা (পিপিআর-২০০৮) অনুসরণ করা হয়নি। অনুমোদিত তালিকার বাইরের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ক্রয় কমিটির সুপারিশ ও ইসি কমিটি অনুমোদনের অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ব্যাংকটির সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের (পিবিএসএল) ২০২৩ সালের আর্থিক বিবরণী অনুসারে ক্ষতির পরিমাণ ১৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মোট ব্যয়ের সিংহভাগ করা হয় অফিস ভাড়া খাতে। এ খাতে ব্যয় করা মোট ১৩ কোটি টাকার মধ্যে কেবল গুলশান শাখায় ভাড়া বাবদ ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
পিবিএসএলের গুলশান শাখা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডা. এইচবিএম ইকবালের মরহুমা স্ত্রীর মালিকানাধীন প্রিমিয়ার স্কয়ার ভবনের ১ম ফ্লোরের ১০ হাজার ৪০০ বর্গফুট জায়গা ভাড়া নিয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা যায়, ভবনের ১ম ফ্লোরের মাত্র ৫১০ বর্গফুট জায়গা পিবিএসএল ব্যবহার করছে। অবশিষ্টাংশ ব্যাংক চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত চেম্বার, হোটেল রেনেসাঁর (ডা. ইকবালের মালিকানাধীন) মিটিং রুম, কনফারেন্স রুম এবং নতুন ও পুরোনো আসবাবপত্রের গুদাম হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। এভাবে প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে ৩০ কোটি টাকা আদায় করতেন ইকবাল ও তার পরিবারের সদস্যরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন অনুযায়ী, এই ভাড়ার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়েই ফ্লোর ব্যবহার করতে পারত ব্যাংক। ফলে প্রতি মাসে গড়ে ২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে ব্যাংকটিকে। বছরে গড়ে বাড়তি ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৪০ কোটি টাকা। চার বছরে এভাবে এক হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হয় ব্যাংকটির। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডাররা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ঋণের তথ্য গোপন করারও অভিযোগ
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে ব্যাংকটির কিছু অনিয়ম উঠে এসেছে; যা ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের অত্যধিক ক্ষমতার প্রয়োগের ইঙ্গিত দেয়। দি প্রিমিয়ার ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের (পিবিএসএল) ঋণ বিতরণ, সুদ আরোপ ও মওকুফের ক্ষেত্রে কিছু অনিয়মের উল্লেখ রয়েছে। ঋণের তথ্য গোপন করারও অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিবিএসএলকে ২৩০ কোটি টাকা ঋণ দেয় প্রিমিয়ার ব্যাংক। এর মধ্যে ব্যাংকটির বনানী শাখা কর্তৃক প্রদত্ত ১২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকার তথ্য বনানী শাখার শ্রেণিকৃত ঋণের (সিএল) বিবরণীতে প্রদর্শন করা হলেও অবশিষ্ট ১০৬ কোটি টাকার তথ্য সিএল বিবরণী থেকে কৌশলে গোপন রাখা হয়; যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১০৯ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ওই পরিদর্শন পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আরও দেখা যায়, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৮/১)(খ) ধারা লঙ্ঘন করে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) নির্দেশনা লঙ্ঘন করে পিবিসিএলকে দেওয়া ঋণের ওপর মাত্র ৫ শতাংশ সুদ আরোপ করা হয়, অথচ তখন ব্যাংকটির ঋণের ঘোষিত সুদের হার ছিল ৯ শতাংশ। ২০২৩ সালের আর্থিক বিবরণী অনুসারে পিবিএসএলের ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ওই শাখার পারফরম্যান্স রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনজন কর্মকর্তার মাধ্যমে এক বছরের নিট কমিশন আয় মাত্র ৭২ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।
প্রিমিয়ার ব্যাংক ফাউন্ডেশনের অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যয়
প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধ কার্যক্রমের (সিএসআর) টাকাও বেহাত হয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংকে। জানা গেছে, প্রিমিয়ার ব্যাংক ফাউন্ডেশনের সংঘস্মারক অনুযায়ী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের মোট পরিচালন মুনাফার ১ শতাংশ অথবা ১ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি তা ফাউন্ডেশনে অনুদান হিসেবে প্রদানের বিধান রয়েছে। তবে সেই বিধান লঙ্ঘন করে এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কোনো অনুমোদন ছাড়াই ২০২৩ সালে ৩০ কোটি এবং ২০২৪ সালে আরও ৫ কোটি টাকা অনুদান নেয় প্রিমিয়ার ব্যাংক ফাউন্ডেশন। সেই অনুদান নিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডা. ইকবাল ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ন্ত্রণাধীন বা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের ব্যয় দেখানো হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জেড রহমান প্রিমিয়ার ব্যাংক স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নামীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। তা ছাড়া প্রিমিয়ার ব্যাংক কর্তৃক আর্থিক বিবরণীতে ব্যাংক ও রিলেটেড পার্টির মধ্যে সম্পর্ক এবং সংঘটিত লেনদেনের তথ্য উল্লেখ করার অনেক ক্ষেত্রে তথ্য গোপন কিংবা আংশিক তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলধন ও সঞ্চিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছেও বলে জানতে পারেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রিমিয়ার ব্যাংকের মহাখালী শাখায় ২০২৩ সালে ‘কম্পেনসেশন রিয়ালাইজড’ হিসাব থেকে ২৫ কোটি টাকা আয় খাতে স্থানান্তর করা হয়েছে; যা ইসলামি শরিয়াহ আইনের চরম লঙ্ঘন বলেও জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক হিসাব ও ক্রেডিট কার্ড জব্দের আদেশ
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ডা. এইচবিএম ইকবাল, তার স্ত্রী, সন্তান ও তাদের অর্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামীয় ব্যাংক হিসাব ও ক্রেডিট কার্ড (সংযুক্ত তালিকাভুক্ত কর্তৃক) জব্দ করার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। আদালত ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিকভাবে আদেশ প্রদান করেন। এ ছাড়া, আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৭টি বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম চলমান। তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থে তাদের আর্থিক লেনদেন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতির অর্থে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ইকবাল
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি প্রিমিয়ার গ্রুপ অব কোম্পানিজ লিমিটেড, দ্য প্রিমিয়ার ব্যাংক, প্রিমিয়ার ফাউন্ডেশন এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হন। ব্যাংকিং, হোটেল ও রিসোর্ট, প্রস্তুতকারক, সিমেন্ট, ডিস্ট্রিবিউশন হাউস, এভিয়েশন, মেডিকেল সেন্টার, শিক্ষা, পরিষেবা খাত, ড্রেজিং, নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনি প্রিমিয়ার হোটেলস অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেড এবং প্রিমিয়ার হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে যথাক্রমে রেনেসাঁ হোটেল, ঢাকা (ম্যারিয়ট গ্রুপ) এবং হিলটন হোটেল বাংলাদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক। আরও রয়েছে নার্সিং ইনস্টিটিউট, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কারিগরি উন্নয়ন কেন্দ্র, আইটি পার্ক, ক্রীড়া একাডেমি এবং ড. মমতাজ বেগম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (প্রস্তাবিত) বিশ্ববিদ্যালয়।
তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাঁশগাড়ি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ইকবাল ও তার পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইকবাল ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ইকবালের দুই স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শিল্পী ও প্রয়াত মমতাজ বেগম, দুই ছেলে মঈন ও ইমরান এবং মেয়ে নওরিনের হিসাব জব্দ করে।
ডা. ইকবাল দেশে না থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার ব্যবহƒত মোবাইল ফোন ও হোয়াসটঅ্যাপে কল দিলেও তাতে সাড়া দেন না কেউ। বার্তা পাঠালেও কেউ উত্তর দেননি। সম্প্রতি ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. ফোরকান হোসেন বলেন, ‘একটিমাত্র মিটিং আমরা করেছি। ব্যাংকটিতে ঘটে যাওয়া অনিয়মের যথাযথ প্রমাণ আমাদের হাতে এলে আমরা অবশ্যই সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।’