জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে প্রায় দেড় হাজার মানুষ হত্যার অভিযোগ কাঁধে নিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশছাড়া হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। বিদেশে পালানোর পর কিছুদিন ঘাপটি মেরে থাকলেও আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। জুলাই অভ্যুত্থানের সংগঠক থেকে শুরু করে সরকারের উপদেষ্টাদের টার্গেট করতে থাকেন অনলাইনে-অফলাইনে।
রাজনৈতিক নেতা ও গোয়েন্দারা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে আসার নেপথ্যে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা উচিত। তা ছাড়া রাজপথে সহিংসরূপে ফেরারি আওয়ামী লীগের উপস্থিতির বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। তা ছাড়া দলটি দেশে বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টা করছে।
এ জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরা ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে আত্মগোপনে থেকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন। তবে ঢাকার মধ্যে তেজগাঁও, শাহাবাগ, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রবাড়ী, মোহাম্মাদপুর, ওয়ারী, মতিঝিল, বসুন্ধরা, গুলশানসহ বেশ কিছু এলাকায় তারা আধিপত্য দখলের চেষ্টা করছেন।
এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে আসার নেপথ্যে হচ্ছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির দ্বন্দ্ব। মূলত এসব দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ হটানো সময়ের ঐক্য ও মতাদর্শ এক ছিল। ৫ আগস্ট-পরর্বতী সেই ঐক্য আর দেখা যায় না। বরং দিনের পর দিন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ দেখা গেছে। সেখান থেকেই রাজনৈতিক সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ, যার কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে ঝটিকা মিছিলের মাধ্যমে নিজেদের মাঠে জীবিত থাকার বার্তা দিচ্ছেন।
বিশ্লেষকদের দাবি, সম্প্রতি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ধরতে পারলেই পুলিশ সদস্যদের ৫ হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হবেÑ এমন খবর প্রকাশ করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এরপর থেকে আরও বেশি মিছিল ও নৈরাজ্যের চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ। কাজেই বলা যায়, পুরস্কার ঘোষণা করেও ঠেকানো যাচ্ছে না দলটির মিছিল। যদিও এর দায়ভার পুলিশ এড়িয়ে যেতে পারে না।
তবে সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন মহলের কাছে প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগ এখন কোন পথে এবং তাদের আবার রাজনৈতিক মাঠে ফেরানোর নেপথ্যে কারা? নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাই কারণ?
সূত্রমতে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে সারা দেশ থেকে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল থেকে প্রায় ২০৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল বুধবার শুধু রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিল থেকে ২৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) মো. নজরুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, আটক নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ১৪টি ককটেল এবং ৬০টি ব্যানার উদ্ধার করেছে ডিএমপি। এ ছাড়া এর আগেও এমন ঝটিকা মিছিল থেকে পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নজরুল ইসলাম।
আওয়ামী লীগ ধরলে পুরস্কার:
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ধরতে পারলেই পুলিশ সদস্যদের ৫ হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ ধরলে টাকা পুরস্কার, তাতে কী লাভ হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এই সংগঠনের বিরুদ্ধে আমরা ইতিমধ্যে জনগণকে ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সচেতন হতে অনুরোধ করেছি। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলসহ অন্যান্য কার্যক্রম প্রতিরোধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নয়।
হোটেল-ফ্ল্যাট-ছাত্রাবাসে আওয়ামী লীগ কর্মীর তথ্য চায় পুলিশ: এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম জানান, আবাসিক হোটেল, ফ্ল্যাট ও ছাত্রাবাসে লুকিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মীদের সন্ধান চেয়ে সাধারণ মানুষের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। যারা কার্যক্রম নিষিদ্ধ সংগঠনটির কর্মীদের তথ্য দেবেন, তাদের নাম-পরিচয় গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী যেসব ঝটিকা মিছিল বের করছে, এসব মিছিল প- ও তাদের ধরতে আমরা তৎপর। এসব কাজেও জনসাধারণ পুলিশকে সহায়তা করেছে।’
তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্টের চেষ্টা করছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টায় লিপ্ত:
গেয়েন্দা তথ্য ও দেশের সচেতন মহলের বিশ্লেষণ, হাঁটি হাঁটি পা পা করে দেশ যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে, তখন নানা ইস্যুতে শুরু হয়েছে অস্থিরতা ও সহিংসতা। নির্বাচনের আগেই দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরির চক্রান্ত চলছে। এই সহিংসতা, অস্থিরতা ও অরাজকতায় ঘি ঢালছেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কখনো প্রকাশ্যে, আবার কখনো নেপথ্যে থেকেই দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে কলকাঠি নাড়ছে ক্ষমতাচ্যুত দলটি। সাম্প্রতিক সময়ে স্পর্শকাতর ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছেন পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির নেতাকর্মীরা। তাদের কাছে নির্দেশ এসেছে বিদেশে পলাতক নেতাদের তরফ থেকে।
পলাতক গডফাদারদের বার্তাÑ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনোভাবেই স্বাভাবিক থাকতে দেওয়া যাবে না, কোনো অনাকাক্সিক্ষত-অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে যেকোনো মূল্যে সেখানে সুযোগ নিতে হবে। এ ধরনের বার্তা পাওয়ার পর দলীয় কর্মীরা এরই মধ্যে মাঠে নেমেছেন। তারা বড় ধরনের নাশকতার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি যৌক্তিক-অযৌক্তিক অন্দোলনে আন্দোলনকারী সেজে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ‘নির্বাচনকালীন ও নাশকতা প্রতিরোধে দায়িত্ব পালনে সক্ষম করতে সারা দেশের দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন ভেন্যুতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের অপশক্তি এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আমাদের সাঁড়াশি অভিযান চলছে।
আইজিপি বলেন, অপকর্মে জড়িত কেউই ছাড় পাবে না। ভিডিও ও গোয়েন্দা তথ্য কাজে লাগিয়ে সব অপশক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। বিভিন্ন আন্দোলন-কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অংশ নিচ্ছে। আমরা তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনছি। ইতিমধ্যে বেশ কিছু গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
এ বিষয়ে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েই শেখ হাসিনার পতন করেছে। আওয়ামী লীগের নৈরাজ্য পতনের ক্ষেত্রে সবাই আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে বলে আশা করি।’
আতঙ্কিত পুলিশের চেয়ার রক্ষায় তৎপরতা:
ঢাকার কোনো থানা এলাকায় আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল হলে জবাবদিহি করতে হবে সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের। পরিদর্শকদের থানা থেকে প্রত্যাহারও করা হবে। ডিএমপির ৫০ থানার ওসি ও পরিদর্শককে এই কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে নিয়ে পুলিশ সূত্র বলছে, ডিএমপির কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর বার্তায় বলা হয়, ‘যেসব থানা এলাকায় ঝটিকা মিছিল হবে, সেই থানার ওসিসহ সবাইকে সে বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। তাদের দায়িত্বে অবহেলা ও শিথিলতার কারণে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার ও করা হচ্ছে।’
কয়েকটি থানার কর্মকর্তারা জানান, ডিএমপি কমিশনারের ওই বার্তার পর থানার পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ৫-১০ জন মিলে হঠাৎ কোনো সড়কে বা গলিতে কয়েক সেকেন্ডের মিছিল করলে খবর পেয়ে সেখানে পুলিশ যাওয়ার আগেই তারা সরে পড়ে। ফলে তাৎক্ষণিক কিছু করা যায় না। পরে ছবি-ভিডিও দেখে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আবার এক এলাকায় মিছিল করছে অন্য এলাকার লোক। এ কারণে তাদের আটক করাও সহজ হচ্ছে না। পুলিশ সদস্যরা এখন সব সময় ঝটিকা মিছিল নিয়ে টেনশনে রয়েছেন।
ঝটিকা মিছিল নিয়ে বিপাকে পুলিশ:
ঝটিকা মিছিলসহ বেআইনি সমাবেশের বিষয়ে মনিটরিং (নজরদারি) জোরদারের কথা জানিয়েছিল সরকার। এ ছাড়া এর নেপথ্যে যারা সক্রিয় রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ঝটিকা মিছিলসহ বেআইনি সমাবেশের বিষয়ে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। নেপথ্যে যারা সক্রিয়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন