বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যখন নির্বাচনের মাঠ গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছে, তখন জাতীয় পার্টি আছে নিজের দলীয় প্রতীক ‘লাঙল’ ধরে রাখার চ্যালেঞ্জে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ‘স্বৈরাচারের দোসর’ আখ্যায় কোণঠাসা দলটির প্রতীক নিতে মরিয়া জাতীয় লীগসহ জাতীয় পার্টির আরও দুটি অংশ। প্রতীক নিয়ে কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। লাঙল নিয়ে চতুর্মুখী দাবিদারদের চাপে বেকায়দায় পড়েছে খোদ নির্বাচন কমিশনও।
সূত্র জানায়, নেতৃত্ব আর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ¦ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টিতে চলছে অস্তস্তি। এরই মধ্যে অন্তত ১০ বার ভেঙেছে দলটি। সর্বশেষ গত আগস্টে দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ওপর সাংগঠনিক কার্যক্রমে আদালতের নিষেধাজ্ঞার সুযোগে দলের ভেতর নতুন মেরুকরণ তৈরি হয়। জি এম কাদের-বিরোধী অংশ ৯ আগস্ট কাউন্সিলের মাধ্যমে আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে চেয়ারম্যান ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব নির্বাচিত করে আলাদা কমিটি ঘোষণা দেয়। কমিটি ঘোষণার পর তারা স্বীকৃতি চেয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠিও দেন। তাদের দাবি, এই কমিটি জাতীয় পার্টির ‘মূল ধারা’। লাঙল প্রতীক ব্যবহারের বৈধ অধিকার শুধু তাদের কমিটিরই আছে। এর আগে গত বছর এরশাদপন্থি রওশন এরশাদের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি করে জাতীয় পার্টি। ওই কমিটিও তাদের মূল কমিটি দাবি করছে। এ ছাড়াও সম্প্রতি শর্ত পূরণ করা জাতীয় লীগও লাঙল তাদের প্রতীক বলে দাবি করছে। দলটির নেতারা বলছে, ১৯৬৯ সালে জাতীয় লীগ যখন যাত্রা শুরু কওে, তখন দলীয় প্রতীক ছিল লাঙল। পরে এ প্রতীক এরশাদের জাতীয় পার্টি জোর করে নিয়ে গেছে। এখন পুনরায় এটি ফিরে পেতে চায় তারা।
এদিকে দলীয় প্রতীক নিয়ে টানাটাটি চললেও আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন জি এম কাদেরপন্থি দলটির নেতারা। তারা জানান, ৩০০ আসনে প্রস্তুত রয়েছে প্রার্থী। পরিবেশ বুঝে যেকোনো সময় আসতে পারে ঘোষণা। তবে দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি করছেন বিভিন্ন দলের নেতারা। ইতিমধ্যে গণঅধিকার পরিষদ জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিল ও সমাবেশ করতে গিয়ে জাতীয় পার্টির সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়েছে। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার জেরে গত ২৯ আগস্ট গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক নুরুল হক নুরকে পিটিয়ে আহত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে নুর গুরুতর আহত হলে দেশের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরে গিয়ে উন্নত চিকিৎসাও নিতে হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাপা আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে সাজানো ও পাতানো নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে। সেই স্থান থেকে বিভিন্ন মহল তাদের নির্বাচনে দেখতে না চাইলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে রাষ্ট্র।
লাঙল প্রতীকের বিষয়ে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জি এম কাদের ছাড়া আইনত অন্য কারো জাতীয় পার্টির (জাপা) লাঙল প্রতীক পাওয়ার সুযোগ নেই। অন্য কারো জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ দলের গঠনতন্ত্র ও আইনে নেই। এরশাদের লাঙল জি এম কাদেরের কাছেই আছে এবং থাকবে।
জাপার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে শামীম হায়দার বলেন, আমরা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। আশা করি, নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। সবার অংশগ্রহণে একটি সুন্দর ভোটের মাধ্যমে দেশে নতুন গণতন্ত্রের আলো ফুটবে। যদিও আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ মনে করি না। তবে ইসিকে নিরপেক্ষ দেখতে চাই। সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিবেশ বজায় থাকলে অবশ্যই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে জাতীয় পার্টি। দলের চেয়ারম্যান ৩০০ আসনের প্রার্থী প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাচাই করে রেখেছেন, দল উপযুক্ত সময়ে তা ঘোষণা করবে। নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্য যেসব শর্তের কথা আইনে আছে, তার কোনোটাতেই জাতীয় পার্টি পড়ে না। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি তোলা হচ্ছে, তা দুঃখজনক।
নির্বাচনের বিষয়ে জাতীয় পার্টির (একাংশ) মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘জাতীয় পার্টি নির্বাচনমুখী দল। ’৯০-এর পরে একটি ছাড়া আমরা সব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। জাতীয় পার্টি বিশ্বাস করে, নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে সরকারে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই আগামী নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি জোট করে নির্বাচন করবে। কাদের সঙ্গে জোট হবে, সে ব্যাপারে শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে নির্বাচনের আগে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হতে হবে।’ প্রতীক এবং আসন্ন নির্বাচনে জাপার অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, আইন ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমাদের নেতৃত্বই জাতীয় পার্টির একমাত্র বৈধ নেতৃত্ব এবং লাঙল প্রতীকের একমাত্র দাবিদার।
তিনি আরও বলেন, দেশের শহর-বন্দরে, গ্রাম-নগরে এখনো বিরামহীনভাবে চাঁদাবাজি চলছে। চলছে মামলা-বাণিজ্য। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মানুষের মাঝে অস্থিরতা। এর মধ্যে কীভাবে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন সম্ভব, আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
আসন্ন নির্বাচনে জাপার অংশগ্রহণ প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জুলাই অভুত্থানের পরিবর্তিত পেক্ষাপটে জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোট পতিত সরকারের সহযোগী হিসেবে আওয়ামী লীগের ‘দোসর’ হিসেবে তকমা পেয়েছে। তারা ফ্যাসিবাদের দীর্ঘদিনের সহযোগী বা দোসর হিসেবে বিগত সরকারের অপকর্মের অংশীদার হিসেবে বিবেচিত। তাদের সহযোগিতায় দীর্ঘদিনের শাসন নিশ্চিত হয়েছে। গুরুতর এমন নানা বিষয় তুলে ইতিমধ্যে জাপাকে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে দেশের সব রাজনৈতিক দল। তিনি বলেন, ২০২৪ সাল, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে। ফলে ফ্যাসিবাদের সরাসরি অংশ বা দোসর হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না দিতে দাবিও উঠেছে। তবে জাপা বা অন্য কোনো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না, সে সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের।
এদিকে নানা ইস্যুতে বিভক্ত জাপার তিনটি অংশের প্রতীক নিয়ে বিরোধের দীর্ঘ লড়াইয়ে এবার নতুন করে যোগ হয়েছে লাঙলের জাতীয় লীগ। দলটি নিবন্ধনের জন্য সব শর্ত পূরণ করেছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। দলটির নেতারা বলছেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ১৯৬৯ সালে জাতীয় লীগ যখন যাত্রা শুরু করে, তখন দলীয় প্রতীক ছিল লাঙল। এই প্রতীক নিয়ে তিনি একাধিকবার নির্বাচনও করেছেন। পরে এ প্রতীক এরশাদের জাতীয় পার্টি জোর করে নিয়ে গেছে। এখন পুনরায় এটি ফিরে পেতে চায় তারা।
জাতীয় লীগের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম বলেন, ‘দীর্ঘদিন পথচলার পর আমাদের দলটি ইসির নিবন্ধন পাচ্ছে। আমাদের দল থেকে লাঙল প্রতীকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আতাউর রহমান খান। তিনি প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। কুমিল্লা থেকে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন প্রফেসর মফিজুল ইসলাম। তিনিও কিন্তু লাঙল প্রতীকে এমপি হন। সুতরাং লাঙল প্রতীকের হকদার বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। দলটির পুরোনো ঐতিহাসিক প্রতীক লাঙল ফিরে পেতে আমরা নির্বাচন কমিশনে আবেদন করব।’
তিনি আরও বলেন, লাঙল হারানোর পর আমাদের প্রতীক ছিল আনারস। সেই প্রতীকও অন্য দলকে দেওয়া হয়েছে। এরপর আমরা ‘কলার ছড়ি’ নাম দিয়ে রেখেছি। একটি প্রতীকের নাম দিতে হয় তাই দিয়েছি, তবে আমরা লাঙল প্রতীক চাইব ইসির কাছে।
তবে জাপার নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ইসির নিবন্ধিত দলগুলোকে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম চালু হওয়ার পর লাঙল নিয়ে কোনো দাবিদার ছিল, এমন কোনো দলের নাম তারা শোনেননি। তবে হঠাৎ কেন এই টানাটানি, নিশ্চয়ই দুরভিসন্ধি রয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে নিবন্ধন প্রথা চালুর আগে কেউ নির্বাচন করে থাকলেও তারা নিবন্ধিত না হওয়ায় নতুন করে লাঙল প্রতীকের দাবিদার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কে প্রতীক দাবি করল কি করল না, তাতে তারা মোটেই বিচলিত নন।