বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান দিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যে আলোচনায় উঠে এসেছে প্রধান সব দ্বিপক্ষীয় বিষয়। গতকাল বুধবার তাদের এ বৈঠক হওয়ার কথা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের (সিএসসি) সপ্তম জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও তার দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সিএসসি’র কাজ এবং প্রধান প্রধান দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন তারা।’ তবে দ্বিপক্ষীয় কোন কোন বিষয় তাদের আলোচনায় ছিল তা স্পষ্ট করেনি বাংলাদেশ হাই কমিশন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সুবিধাজনক সময়ে’ বাংলাদেশ সফরের জন্য অজিত দোভালকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন খলিলুর রহমান।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পাঁচ দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সম্মেলনে যোগ দিতে ভারত সফরে গেছেন খলিলুর; যিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রোহিঙ্গা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্তবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভও। গতকাল বুধবার যাওয়ার কথা থাকলেও একদিন আগেই দিল্লিতে পৌঁছান তিনি। আজ বৃহস্পতিবার কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেবেন তিনি।
গণঅভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আসা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে দুই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার এ বৈঠক হলো।
ছাত্র-জনতার তুমুল গণআন্দোলনে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারত সরকারের ‘অতিথি’ হিসেবে দিল্লিতে তার অবস্থানের কথা লিখেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। সেই থেকে বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার পাশাপাশি দিল্লিতে বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রচেষ্টার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে করে আসছে ইউনূস সরকার। অপরদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে ভারত সরকার। পাশাপাশি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও অপতথ্য’ এবং ‘অতিরঞ্জিত প্রচারণার’ অভিযোগ বাংলাদেশ সরকার করেছে।
বিভিন্ন বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত ইস্যু এবং দিল্লি থেকে দেওয়া শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক তলবের ঘটনাও ঘটেছে। কূটনৈতিক এ টানাপোড়নের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঘটনাও ঘটে। সবশেষ ১৭ মে স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য আমদানি বন্ধের ঘোষণা দেয় ভারত।
সবশেষ দিল্লি থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়া থেকে শেখ হাসিনাকে রাখার কারণ জানতে ১২ নভেম্বর ঢাকায় ভারতের উপ-হাই কমিশনারকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাকে সোমবার ফাঁসির রায় দেওয়ার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে ফেরত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
জুলাই আন্দোলন দমাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় হাসিনার সঙ্গে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও। রায়ের পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও আবার ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
এর আগে যখন হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, তখন দুদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী তাকে ফেরত দিতে গত ডিসেম্বরে দিল্লিতে চিঠি পাঠিয়েছিল ঢাকা। এর মধ্যে একটি মামলার বিচারকাজ শেষ হয়ে গেলেও ফেরত চেয়ে পাঠানো চিঠির কোনো জবাব দেয়নি ভারত সরকার। ঢাকার পাঠানো চিঠির বিষয়ে গত মাসে এক প্রশ্নে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছিলেন, আইনি বিষয়গুলো পর্যালোচনা করছে দিল্লি।
রায়ের পর আবার সোমবার ফেরত চাওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আজকের রায়ে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল জুলাই হত্যাকা-ের জন্য অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং দ-প্রাপ্ত হয়েছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-প্রাপ্ত এই ব্যক্তিদের দ্বিতীয় কোনো দেশ আশ্রয় দিলে তা হবে অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ আচরণ এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞার শামিল।’
‘আমরা ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানাইÑ তারা যেন অনতিবিলম্বে দ-প্রাপ্ত এই দুই ব্যক্তিকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন। দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুসারে এটি ভারতের জন্য অবশ্য পালনীয় দায়িত্বও বটে।’
রায়ের দিন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, হাসিনাকে ফেরত চেয়ে আবারও দিল্লিতে চিঠি পাঠাবে সরকার। অপরদিকে রায়ের পর এক সাদামাটা বিবৃতিতে রায় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা অবগত হওয়ার কথা তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের ‘সর্বোত্তম স্বার্থের’ প্রতি দিল্লি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতার মিশেলে সেই স্বার্থ এগিয়ে নিয়ে ‘সব অংশীজনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে আলোচনায় সম্পৃক্ত’ হওয়ার ইচ্ছার কথা বলা হয় ওই বিবৃতিতে।

