টেলিগ্রামে যেখানে একদিকে মুক্তভাবে যোগাযোগ হয়, অন্যদিকে সেই মুক্ততা ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে এক অন্ধকার ও ভয়ংকর জগৎ। হ্যাঁ, আমরা বলছি টেলিগ্রামে অবাধ পর্নোগ্রাফি ব্যবসার কথা। সাধারণ মেসেজিং অ্যাপ থেকে এখন এটি হয়ে উঠেছে অবৈধ যৌন কন্টেন্টের এক হটস্পট। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে অনেক গ্রুপ ও চ্যানেল গড়ে উঠেছে। যেখানে টাকার বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছে নারীদের নগ্ন ছবি, ভিডিও। এমনকি কখনো কখনো ব্লাকমেইল করে আদায় করে নেওয়া হচ্ছে অর্থ। আমরা সন্ধান পাই এমন বেশকিছু টেলিগ্রাম চ্যানেলের যেখানে টাকার বিনিময়ে মাসিক সাবস্ক্রিপশনে বিক্রি হচ্ছে নারীদের নগ্ন ভিডিও।
আমরা নতুন একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ছদ্মনামে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করি কয়েকটি চ্যানেলের মূল এডমিনের সঙ্গে। চ্যানেলে বলা আছে প্রিমিয়াম নিতে এডমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, আমরাও শুরুতে জানতে চাই তাদের প্রিমিয়াম সেবা সম্পর্কে। দেখা যাক কী তথ্য দেন তারা। নারীদের নগ্ন ভিডিও বিক্রির একটি চ্যানেলের মূল এডমিন রোমান ইসলাম। তার চ্যানেল থেকে জানতে পারি তার কাছ থেকে প্রিমিয়ার সার্ভিস নিতে ইনবক্সে যোগাযোগ করতে হবে আমরা যোগাযোগ করি তার সঙ্গে। তার গ্রুপে তিনি জানিয়েছেন প্রিমিয়ার সার্ভিস নিতে দিতে হবে ৫০০ টাকা। আমরা জানতে চাই এটা কীভাবে নিতে হবে? ফিরতি টেক্সটে নোমান জানান ৫০০ টাকা বিকাশে পাঠালেই মিলবে লিঙ্ক! এবার আমরা পেয়েছি একটি বিকাশ নাম্বার খোঁজ নিয়ে দেখা যাক বিকাশটি কার নামে রেজিস্ট্রেশন? রেজিস্ট্রেশন কার নামে জানার আগে চলুন জেনে নেই কীভাবে এই চ্যানেলে মূলত লোকজন জয়েন হয়? প্রথম ধাপে এরা ফেক ফেসবুক আইডি থেকে নানা অনেক রিচ পাওয়া পোস্টের কমেন্টে নানা আবেদনময়ী ভিডিও আছে জানিয়ে টেলিগ্রামের এসব চ্যানেলের লিঙ্ক প্রচার করতে থাকেন। প্রথম ধাপে ফেসবুকে থেকে মানুষকে টেলিগ্রামের চ্যানেলে আনার পর সেখানে প্রাথমিকভাবে নানা সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা জনপ্রিয় ব্যক্তিদের আপত্তিকর ভিডিও ছবি দিয়ে, পরবর্তীতে প্রচার চালায় প্রিমিয়াম সার্ভিসের, আর হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। আবারও ফিরতে চাই নোমানের কাছে, নোমানের থেকে আমরা যে বিকাশ নাম্বারটি পেয়েছি সেটির খোঁজ নিয়ে জানা যায় বিকাশ রেজিস্ট্রেশন আছে রানু বেগম নামে!
একটি চ্যানেলের মূল এডমিন লাবিব। তার থেকেও জানার চেষ্টা করি কীভাবে নিতে হবে প্রিমিয়াম? ফিরতি মেসেজে দেখে চোখ কপালে ওঠার পালা! লাবিবের কাছে মিলবে প্রতিদিন ২০০+ কালেকশন! রয়েছে ১৫ দিন, ১ মাস, ২ মাস, ৫ মাস ও ১ বছরের প্রিমিয়াম মেম্বারশিপ! কৌতূহল নিয়ে আমরা জানতে চাই আসলেই তার কাছে কত এমন আপত্তিকর ভিডিও আছে, পাঠালেন বেশ কয়েকটি ছবি, এবার চোখ সত্যিই চড়কগাছ! আমরা এবার জানতে চাই অপ্রাপ্তবয়স্ক কলেজ পড়ুয়াদের আপত্তিকর ছবি ভিডিও আছে কি না? জানান তাও মিলবে তার কাছে। নেই মানে কিছু নেই, এখানে সবই যেন আছে। এবার আমরা তার থেকেও জানতে চাই পেমেন্ট পদ্ধতি। পাঠান বিকাশ নাম্বার, এবারও রেজিস্ট্রেশন চেক করতে আগের মতোই আবার করা বিষয়। এখানে লাবিব হলেও বিকাশের রেজিস্ট্রেশন তথ্য বলছে সিমের বিকাশ অ্যাকাউন্টটি রেজিস্ট্রেশন আছে মোসা লাকি আরা নামে। চেক করি নগদ রেজিস্ট্রেশন সেখানেও মোসা লাকি আরা! সন্ধান পাই এমন একটি চ্যানেলের যার মূল এডমিন আইডিই প্রিমিয়ার সার্ভিস নামে তার কাছেও আছে মেম্বারশিপ পদ্ধতি তবে আমরা জানতে চাই তার কাছে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা আছে কি না? জানালেন আছে, দেখতে চাইলে ছবিও পাঠালেন।
আমাদের উদ্দেশ্য কোনো একটি চ্যানেলের মূল এডমিনের সঙ্গে সরাসরি দেখা করা। এবার আমরা জানতে চাই কত কম বয়সি মেয়ে তাদের কাছে আছে? জানতে পারি ১৯ বছরের আছে, কলেজ পড়ুয়া এর কম বয়সি আর নেই। এবার আমরা জানতে চাই ভিডিওর বাহিরেও তারা ভিডিও কলে যৌন ব্যবসা পরিচালনা করেন। জানতে চাই সে সম্পর্কে। জানালেন টাকা পাঠিয়ে নিশ্চিত করলে যোগাযোগ করিয়ে দেবে টেলিগ্রামে, সব কিছুই যেন টেলিগ্রামে।
আমাদের উদ্দেশ্য সরাসরি যোগাযোগ। তাই জানতে চাই হোম সার্ভিস বা এমন কিছু আছে কি না। জানান তাদেরই একজন দিতে পারবে তবে তার কাছে নেই। যোগাযোগ করতে হবে টেলিগ্রামে। আমরা সম্মতি জানাই। এবার একটি টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে যোগাযোগ করা হয় আমাদের সঙ্গে জানানো হয় মেয়ে লাগবে কি না, সাড়া দেই আমরা। জানান এক রাতের জন্য দিতে হবে ৮ হাজার টাকা, অগ্রিম দিতে হবে অর্ধেক! ছলেকলে আমরা সাক্ষাৎ করতে চাই হোটেলে, পেমেন্ট ছাড়া হোটেলে সাক্ষাতে রাজি না হলেও আমরা সুযোগ পাই একটি ফোন কলের।
দিনে রাতে যখন চাই যেমন চাই তেমন মিলবে তাদের কাছে দাবি করলেন এমনটাই। নির্দিষ্ট কোনো কলেজের মেয়ে আছে কি-না জানতে চাইলে জানান ‘বেশিরভাগই ইডেনের’। সরাসরি টাকা দিয়ে সাক্ষাৎ রাজি নন, বিশ্বাসের কথা বলতেই শোনালেন, ‘যে নাচতে সে যে কোনো জায়গাতেই নাচতে জানে।’ এবার ‘বেশিরভাগই ইডেনের’ কথার সূত্র ধরে কথা হয় ইডেন কলেজের সাংবাদিক সমিতির আহ্বান স্মৃতি আক্তারের সঙ্গে তিনি জানান, ‘ইডেনের মেয়েরা অনেক দূরে দূরে টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালায়। যারা এমন অভিযোগ করছে তারা নিজেদের স্বার্থে ইডেনের নাম ব্যবহার করে।
দেহ ব্যবসা প্রযুক্তরি অপব্যবহার উল্লেখ করে সাইবার বিশেষজ্ঞ জুবায়ের জানালেন প্রশাসনের প্রমান ও প্রযুক্তিগত ঘাটতি থাকার কারনেই মূলত এসব অপরাধ কমানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রোবফ্লাই আইটি এর প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আল ইমরান জানান, যত দ্রুত এসব ছড়াচ্ছে তত দ্রুত একশন হচ্ছে না। প্রসাশন চাইলে এটি বন্ধ করা সম্ভব বলেও জানান এই সাইবার বিশেষজ্ঞ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও, ডিজিটাল দুনিয়ার এই ছায়া-যুদ্ধে অপরাধীরা এক ধাপ এগিয়ে থাকে। ভিপিএন, ফেক নাম্বার, এনক্রিপশন, সব মিলে তাদের খুঁজে বের করাও কিছুটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া। ডিজিটাল স্বাধীনতা যেন হয়ে না ওঠে অপরাধীদের মুক্ত বিচরণের ক্ষেত্র। সময় এসেছে, এই অন্ধকার জগতের মুখোশ খুলে দেওয়ার।
আপনার মতামত লিখুন :