ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫

জুলাই সনদ : দেশের স্বার্থে ঐকমত্য জরুরি

সম্পাদকীয়
প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৫, ১২:১২ এএম

দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের স্মারক। বাংলাদেশ এবং তার শাসনব্যবস্থার এক সংকটময় পরিস্থিতিতে এই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, যার ফলে দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, সেই সঙ্গে শুরু হয় রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারের এক উচ্চাকাক্সক্ষী প্রচেষ্টা।

এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে যে ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়নের কাজ চলছে, তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। যা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে গণতন্ত্র, সুশাসন ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা নিয়ে ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।  
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সূত্রগুলো বলছে, এরই মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদের একটি খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। 

২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানকে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়ার অঙ্গীকার থাকছে জুলাই জাতীয় সনদে। একই সঙ্গে দেশের সংবিধান সংশোধন, পরিমার্জন ও পুনর্লিখনের প্রতিশ্রুতি, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত সংস্কারের লক্ষ্যে নতুন আইন ও বিধি প্রণয়ন; প্রয়োজনে পুরোনো আইনে সংশোধন এবং সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যে সুপারিশগুলোর বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করবে, সেই সুপারিশ বাস্তবায়নে সাত দফা অঙ্গীকারনামা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ।

জুলাই সনদ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা। রূপালী বাংলাদেশে ‘জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক বিভাজনে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত’ শিরোনামে প্রকাশিত খবর থেকে  জানা যায়, জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে ঘোষিত ‘জুলাই সনদ’ এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য, অবিশ্বাস এবং পদ্ধতিগত জটিলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও আরও কয়েকটি দল সনদের খসড়া নিয়ে তীব্র আপত্তি তুলেছে, যার ফলে ঐকমত্যের প্রক্রিয়া ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।

পদ্ধতিগত অসঙ্গতি ও আইনি নিশ্চয়তার দাবি করে এনসিপি বলছে,   আমরা এটির তীব্র বিরোধিতা করছি। আলোচনার পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা হয়নি, অথচ তারা হঠাৎ করে খসড়া প্রকাশ করেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ছয়টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতির কথা বললেও কোনো পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত হবে, তা নির্ধারণ না করেই খসড়া প্রকাশ করেছে। এটা এক তরফা পদক্ষেপ।

অন্যদিকে, জুলাই সনদের খসড়াকে ‘অসম্পূর্ণ ও বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করে জামায়াতে ইসলামী বলছে, আজ তারা বলছে এটা নমুনামাত্র।যদি সেটাই হয়, তাহলে মন্তব্যের দরকার নেই। আর যদি সেটাই মূল খসড়া হয়, তাহলে এটি গ্রহণযোগ্য নয়।

জামায়াত চাইছে, তারা নিজস্ব একটি বিকল্প খসড়া সনদ তৈরি করে কমিশনে জমা দিতে। সেই খসড়ায় আইনি কাঠামোর দুটি বিকল্প থাকবে। প্রথমটি অধ্যাদেশ জারি করে পরে সংসদে অনুমোদন। আর দ্বিতীয়টি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন।

তবে  ঐকমত্য কমিশনের খসড়ার সঙ্গে মোটামুটি একমত বিএনপি।  দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, খসড়ার সঙ্গে তারা মোটামুটি একমত। অঙ্গীকারের বিষয়েও বিএনপি একমত। খসড়ায় শব্দ-বাক্য গঠন-সংক্রান্ত বিষয়ে বিএনপি তাদের পর্যবেক্ষণ কমিশনকে জানাবে।

আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শেষ করে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা এখনো শেষ হয়নি। 
‘জুলাই সনদ’ কেবল একটি রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির আহ্বান নয়, এটি জাতির সার্বিক আকাক্সক্ষার প্রতিফলন।

একটি কার্যকর, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রত্যাশা। দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক অনৈক্য, ক্ষমতা কেন্দ্রিক সংঘাত এবং প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, ভেঙে পড়ছে প্রশাসনিক ভারসাম্য এবং সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায়।

দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এখন সময় এসেছে সব রাজনৈতিক দল ও পক্ষকে  ঐকমত্যের ছাতার নিচে আসার। এই ঐকমত্য হতে হবে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

রাজনৈতিক দলগুলোকে ভুলে গেলে চলবে না, ঐকমত্য মানে ভিন্নমতের অনুপস্থিতি নয়। বরং মতের বৈচিত্র্যকে সম্মান জানিয়ে, গণতান্ত্রিক সহনশীলতায় পৌঁছানোই সত্যিকারের ঐকমত্য। 

জুলাই সনদ কেবল একটি সময়ের দলিল হবে না, বরং এটি উঠবে নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা। যদিও কাজটি কঠিন, তবে রাজনৈতিক দলগুলো আন্তরিকতার পরিচয় দিলে তা অসম্ভব কিছু নয়।

আমরা আশা করব, দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলো দেশের বৃহৎ স্বার্থে সকল অহং ত্যাগ করে, জনগণের কল্যাণে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সূচনায় ভূমিকা রাখবে।