ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর মালিকানাধীন গাজী টায়ার্স কারখানায় হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ ঘটে। এতে অন্তত ১৮২ জন নিখোঁজ হন বলে সরকারি তদন্তেও নিশ্চিত হওয়া গেছে। এক বছর পার হলেও তাদের উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। স্বজনদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এখন শুধু নিখোঁজদের অন্তত লাশটুকু পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
টানা পাঁচ দিন জ্বলেছিল আগুন
গত বছর ২৫ আগস্ট রাতে কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলে টানা পাঁচ দিন ধরে ভবনটি জ্বলতে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট টানা ২২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন আংশিক নিয়ন্ত্রণে আনলেও পুরোপুরি নেভাতে লেগে যায় পাঁচ দিন। দীর্ঘ সময় ধরে আগুনে জ্বলতে থাকা ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ফলে নিখোঁজ শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যরা প্রিয়জনদের লাশও পাননি।
সরকারি তদন্তে উঠে আসা চিত্র
নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক ঘটনার পরই ২৭ আগস্ট একটি আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিটি ১২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে ৩২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় পর্যায়ে কারখানার মালিক গাজীর গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে লোকজন আনন্দ মিছিল করে। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত কয়েক দফায় দুষ্কৃতকারীরা কারখানায় প্রবেশ করে শ্রমিকদের বের করে দিয়ে লুটপাট শুরু করে। বিকেলে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে লুটপাটকারীরা সংঘর্ষে জড়ায়। রাতে তারা ভবনের নিচতলায় আগুন ধরিয়ে গেটের শাটারে তালা ঝুলিয়ে চলে যায়।
ভবনটিতে দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত প্রতিটি তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ভেতরে যারা ছিলেন, তাদের জীবিত উদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে যায়।
উদ্ধার হলো শুধু হাড়গোড়
আগ্নিকাণ্ডের পর স্বজনদের উদ্যোগে ভবন থেকে ১৫ খণ্ড হাড় উদ্ধার হয়, যা পুলিশের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে প্রশাসন ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করায় পূর্ণাঙ্গ উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। তদন্ত কমিটি সুপারিশ করে ভবন ভেঙে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উদ্ধার অভিযান চালানোর। কিন্তু সেই কাজ শুরু হয়নি এখনো।
আগের লুটপাটের তথ্য
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এর আগেও ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত কারখানায় এক দফা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়। এরপর থেকেই ভবনটির বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।
প্রশাসনের বক্তব্য
তৎকালীন জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক বলেন, ‘ভবনটি ভাঙার দায়িত্ব মালিকপক্ষের। আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু মালিকপক্ষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’
বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে অবগত নন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘নিখোঁজদের পরিবার আমাদের কাছে এসেছিলেন। আমরা বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছি, তবে অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসনের তালিকা ধরে নিখোঁজদের খোঁজ চলছে। তাদের মোবাইল নম্বরের সর্বশেষ অবস্থান ও কার্যকরিতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরিবারগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগও করা হচ্ছে। তবে এখনো কাউকেই শনাক্ত করা যায়নি।’
মালিকপক্ষের অবস্থান
গাজী টায়ার্সের এক কর্মকর্তা জানান, ‘ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমরা প্রশাসন ও বুয়েটকে চিঠি দিয়েছিলাম। কোনো সম্মতি পাইনি। সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সেভাবেই কাজ করব।’
অনিশ্চয়তায় ডুবে থাকা পরিবারগুলো
আগুন লাগার পরদিন সকাল থেকেই নিখোঁজদের স্বজনরা কারখানার ফটকে জড়ো হন। পরে প্রশাসন বাধ্য হয়ে তাদের কাছ থেকে নিখোঁজদের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে নাম নিবন্ধন শুরু করে। তবু উদ্ধার কার্যক্রমে কোনো অগ্রগতি হয়নি। হতাশ হয়ে স্বজনরা অন্তত লাশ উদ্ধারের দাবি জানালেও তা-ও পূরণ হয়নি।
অগ্নিকাণ্ডে প্রিয়জন হারানো পরিবারগুলো এখনো অশ্রুসিক্ত চোখে আশার আলো খুঁজে ফিরছেন।
তাদের অভিযোগ, তদন্তে সত্যতা নিশ্চিত হলেও উদ্ধারকাজে কিংবা ক্ষতিপূরণে রাষ্ট্র কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তাই এক বছর পরেও ১৮২ জন মানুষ অদৃশ্য অন্ধকারে হারিয়ে আছেন- যেন এক দুঃসহ নীরবতার ভেতর আটকে থাকা ইতিহাস।
পারভীন নামের এক পরিবারের সদস্য বলেন, ‘তার স্বামী এনজিও থেকে প্রায় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। মৃত্যুসনদ না থাকায় এনজিওগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ মওকুফ করেনি। তিনিও বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করতে পারছেন না। মানুষের মৃত্যুর পর ধর্মীয় বিধি মেনে যে আচার-অনুষ্ঠান করা হয়, তা-ও করতে পারেননি তারা’
পারভীনের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশ থেকে তার মা খাদিজা বেগম বলেন, ‘মইরা গেলে আড্ডিটা তো আছে। এডাই দিত আমাগো। আমরা দাফন করতাম। মনরে সান্ত্বনা দিতাম।’