বাংলাদেশে স্মার্টফোন, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিশেষ করে স্মার্টফোন এখন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক একাধিক জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রতি চারটি পরিবারের মধ্যে তিনটিতে অন্তত একটি স্মার্টফোন রয়েছে।
সোমবার (২৫ আগস্ট) বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) প্রকাশিত এক গবেষণায় স্মার্টফোন ব্যবহারের এ তথ্য উঠে এসেছে।
শহর বনাম গ্রাম
আশ্চর্যজনকভাবে, মোবাইল ফোন ব্যবহারে গ্রাম শহরের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গ্রামে ৯৮.৩% পরিবারের কাছে মোবাইল ফোন রয়েছে, যেখানে শহরে এই হার ৯৭.৭%। তবে স্মার্টফোন ব্যবহারে এখনো শহর কিছুটা এগিয়ে- শহরে ৮১.৬% এবং গ্রামে ৭১.৮% পরিবারের কাছে স্মার্টফোন রয়েছে।
ব্যবহারের ঊর্ধ্বগতি
২০২৪-২৫ অর্থবছরের পিপিআরসি জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের প্রায় ৭৪% পরিবারে অন্তত একটি স্মার্টফোন আছে। এই হার ২০২৩ সালে ছিল ৬৩.৩%, যা থেকে বোঝা যায় স্মার্টফোনের ব্যবহার কীভাবে দ্রুত বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি, ইন্টারনেট প্রবেশাধিকারের সহজলভ্যতা, ডিজিটাল সেবার প্রসার এবং স্বল্পমূল্যের স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা।
তরুণ প্রজন্মই মূল চালক
গবেষণায় দেখা যায়, যেসব পরিবারে তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেশি, সেখানে স্মার্টফোনের ব্যবহারও তুলনামূলক বেশি। তরুণরাই স্মার্টফোন ব্যবহারের মূল চালক হিসেবে কাজ করছেন। একই সঙ্গে দেশের ৬৪% পরিবারে এখন কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে, যার ৮০% মোবাইল নেটওয়ার্ক-নির্ভর।
ল্যাপটপের ব্যবহার এখনো সীমিত
যেখানে স্মার্টফোন প্রায় প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে, সেখানে ল্যাপটপ বা কম্পিউটার এখনো অনেক পিছিয়ে। দেশে মাত্র ৫% পরিবারের কাছে ল্যাপটপ রয়েছে। শহরে প্রতি ১০টির মধ্যে একটি পরিবার এবং গ্রামে প্রতি ৪০টির মধ্যে একটি পরিবারে এই যন্ত্র রয়েছে। আয়ের বৈষম্যের কারণে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ এখনো এসব ডিভাইস ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছে।
ডিভাইস ব্যবহারের উদ্দেশ্য
স্মার্টফোনের সবচেয়ে বড় ব্যবহার মানুষের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা। এর পাশাপাশি পড়াশোনা, বিনোদন, আর্থিক লেনদেন, চাকরি সংক্রান্ত কাজ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকা এবং অনলাইন ব্যবসায় স্মার্টফোন ব্যবহৃত হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৫০% স্মার্টফোন মোবাইল আর্থিক সেবায় (MFS) ব্যবহৃত হয়। এছাড়া, ৮০% ব্যবহারকারী স্মার্টফোনে ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন।
শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার
শিক্ষাক্ষেত্রেও স্মার্টফোন ও ল্যাপটপের ব্যবহার বেড়েছে। প্রায় ৫০% ল্যাপটপ বা কম্পিউটার এবং ২০% স্মার্টফোন শিক্ষামূলক কাজে ব্যবহৃত হয়। শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস, ই-বুক, গবেষণা ও বিভিন্ন কোর্সে যুক্ত হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমের মাধ্যমে। ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স এবং অন্যান্য অনলাইন কাজেও এই ডিভাইসগুলোর ব্যবহার বাড়ছে।
নারী ও পুরুষ: ব্যবহারে ব্যবধান
আইসিটির ব্যবহারে নারী-পুরুষের ব্যবধান তুলনামূলক কম। দেশের ৮৮.২% মানুষ মোবাইল ব্যবহার করেন, যার মধ্যে পুরুষ ৯০.৩% এবং নারী ৮৬.১%। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে পুরুষ ৫২.৯% এবং নারী ৪৪.৪%। এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দেয়, ডিজিটাল ব্যবহারে নারীর অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের অগ্রগতি
গত অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার ১৩% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪.৮%। কম্পিউটার ব্যবহারের হার এখন ৯.২%। শহরে ২১.৯% এবং গ্রামে মাত্র ৩.৭% পরিবারে কম্পিউটার রয়েছে। এখনো ফিচার ফোনের ব্যবহার গ্রামে বেশি, কারণ অনেক সরকারি সামাজিক সুরক্ষা ভাতা সংগ্রহে ফিচার ফোনই যথেষ্ট।
গ্রামে মোবাইল ব্যবহারের কারণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামে মোবাইল ব্যবহারের একটি বড় কারণ হলো প্রবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন। এছাড়া গ্রামীণ জনগণের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা গ্রামের মানুষকে প্রযুক্তির আরও কাছে নিয়ে এসেছে।