২০২০ সালে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এ ভাইরাসকে মহামারী ঘোষণা দেয়। এতে বিশ্বব্যাপী বিধিনিষেধের নজিরবিহীন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যার প্রধান শিকার হয়েছিল অর্থনীতি।
রয়টার্সের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, মহামারী ঘোষণা দেয়ার পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব রয়ে গেছে। একই সঙ্গে সেই জরুরি পরিস্থিতির প্রভাবে সারা বিশ্বে নতুন কিছু প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, কোভিড-১৯ এবং তা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় সরকারগুলো রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, শ্রমবাজার সংকুচিত হয়েছে এবং ভোক্তা আচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। আবার বৈষম্য বাড়ার পাশাপাশি রিমোট ওয়ার্ক, ডিজিটাল পেমেন্ট ও ভ্রমণের অভ্যাসে স্থায়ী পরিবর্তন এনেছে। এরই মধ্যে বিশ্ব মহামারীর প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে। তবে বৈশ্বিক অর্থনীতি এখনো পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুনরুদ্ধারের কাছাকাছি পৌঁছেও গেছে। কভিড-১৯-এর বিধিনিষেধে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে। তখন জনকল্যাণ ও জীবিকা সুরক্ষার জন্য দেশগুলো ব্যাপক পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে। ফলে ২০২০ সালের পর বৈশ্বিক সরকারি ঋণের পরিমাণ ১২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এ বৃদ্ধি বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় বেশি।
মহামারী-পরবর্তী পুনরুদ্ধারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যা কিনা ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দেয়। লকডাউন-পরবর্তী খরচ বৃদ্ধি, সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজ এবং শ্রম ও কাঁচামালের ঘাটতির ফলে ২০২২ সালে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়িয়েছিল, যদিও এর মাত্রা দেশভেদে ভিন্ন ছিল।
অর্থনৈতিক স্থবিরতায় প্রচুর ঋণ গ্রহণ করলেও সরকারগুলোর ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য এ সময় কমে যায়, যা প্রতিফলিত হয়েছে ক্রেডিট রেটিং হ্রাসের মাধ্যমে। বৈশ্বিক ঋণমান সংস্থা ফিচ রেটিংসের তথ্যানুযায়ী, বৈশ্বিক গড় সার্বভৌম ক্রেডিট স্কোর মহামারীর আগে যা ছিল, তার চেয়ে এখনো এক-চতুর্থাংশীয় পয়েন্ট কম। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ গড় অর্ধেক পয়েন্ট কম। নিম্ন ক্রেডিট রেটিং সাধারণত আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণের উচ্চতর খরচ নির্দেশ করে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, মহামারীর কারণে সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছে। এতে দরিদ্র পরিবার ও নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার লকডাউন শিথিল হওয়ার পর চাকরির বাজার পুনরুদ্ধার হলেও তা অনেকটাই আতিথেয়তা ও সরবরাহ চেইন খাতের দিকে সরে গেছে। কারণ ওই সময় অনলাইন খুচরা বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল।
২০২০ সালে নারীদের কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তারা এমন খাতে বেশি কাজ করতেন, যা মহামারীর সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে আবাসন, খাদ্য পরিষেবা ও উৎপাদন। সাম্প্রতিক তথ্যানুযায়ী, লিঙ্গভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবধান কিছুটা কমেছে।
মহামারীতে ভ্রমণ ও অবসর-বিনোদনের অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এখন ২০১৯ সালের মতোই ভ্রমণ ও রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া শুরু করেছে। তবে বাড়ি বসে কাজ করার প্রবণতা বড় শহরগুলোয় যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, লন্ডনে প্রতিদিন ১০ লাখের বেশি মেট্রো ও বাসযাত্রী কমেছে, যা এখনো প্রাক-মহামারী স্তরে ফেরেনি।
মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এয়ারলাইনস শিল্প। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (আইএটিএ) তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে এ খাতে লোকসান হয়েছিল ১৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। পরে ভ্যাকসিন কর্মসূচির কারণে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে উড়োজাহাজ চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে। আইএটিএ প্রত্যাশা করছে, চলতি বছর খাতটি ৩ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার নিট মুনাফা এবং ৫২০ কোটি যাত্রী পরিবহনের নতুন রেকর্ড গড়তে পারে।
ভ্রমণ বাড়লেও পর্যটকদের এখনো উচ্চমূল্যের হোটেল ভাড়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অনেক অঞ্চলে ভাড়া মূল্যস্ফীতির তুলনায় দ্রুত বেড়েছে এবং ২০১৯ সালের স্তরের তুলনায় অনেক বেশি। লাইটহাউজ প্লাটফর্মের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রাক-কভিড সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি হোটেল মূল্য বাড়ে ওশেনিয়া অঞ্চলে, এরপর রয়েছে উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপ।
আবার অফিস ভাড়া শূন্য থাকার হার অনেক দেশে রেকর্ড উচ্চতায় রয়েছে। এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মী রিমোট বা হাইব্রিড মডেলে কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান ব্যবসা কেন্দ্রগুলোয় সবচেয়ে বেশি খালি অফিসের সংখ্যা দেখা গেছে, যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
বৈশ্বিক লকডাউনের সময় বাড়িতে বসে মানুষের অনলাইন কেনাকাটার ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গিয়েছিল। ২০২০ সালে অনলাইনে কেনাকাটার প্রবণতা তীব্রভাবে বাড়ে, যা পরে স্থিতিশীল হয়ে যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপে অনলাইন বিক্রির বৃদ্ধির পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতারা দোকানে বিনিয়োগ করছে, যাতে অনলাইন ও অফলাইন উভয় বিক্রি বাড়ানো যায়। দোকানের পরিমাণ ২০২২-২৩ সালের মধ্যে প্রায় ১ শতাংশ বেড়েছে এবং ২০২৮ সালের মধ্যে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে বাজার গবেষণা সংস্থা ইউরোমনিটর।
ভোক্তা প্রবণতার নতুন চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মহামারীর সময় ডিজিটাল ও ডেলিভারি কোম্পানির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ভ্যাকসিন নির্মাতা কোম্পানির শেয়ারদরেও উল্লম্ফন দেখা যায়। অবশ্য মহামারীর সময় লাভবান হওয়া কিছু কোম্পানি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। আবার কিছু কোম্পানি টিকে আছে ও নতুন বাজার তৈরি করতে পেরেছে।

 
                             
                                    
 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন