বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহে এক নতুন মাইলফলক ছোঁয়া গেছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে এসেছে মোট ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স অর্জনের রেকর্ড। এর আগে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে, যার পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বছরের রেমিট্যান্স গত অর্থবছরের ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় প্রায় ২৬.৮০ শতাংশ বেশি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের পর থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহে নাটকীয় উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রবাসীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়, এর মধ্যে হুন্ডি প্রতিরোধে আইনগত ব্যবস্থা, বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য প্রণোদনা, এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সেবার সম্প্রসারণ অন্যতম। এসব উদ্যোগ প্রবাসীদের বৈধ পথে অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত করেছে এবং ফলাফল হিসেবে রেমিট্যান্স প্রবাহে সৃষ্টি হয়েছে একাধিক রেকর্ড।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মার্চ মাসে দেশে এসেছে ৩.২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স, যা এক মাসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এছাড়া জুন মাসেও এসেছে ২.৮২ বিলিয়ন ডলার এবং মে মাসে ২.৯৭ বিলিয়ন ডলার। এই ঊর্ধ্বগতি প্রমাণ করে, রেমিট্যান্স প্রবাহ এখন কেবল ঊর্ধ্বমুখীই নয়, বরং টেকসই ধারায় রূপ নিচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রেমিট্যান্সের বিস্তারিত চিত্রও ইতিবাচক। জুলাই মাসে এসেছে ২৪৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, আগস্টে ২৪২ কোটি ১৮ লাখ ৯০ হাজার, এবং সেপ্টেম্বরে এসেছে ২৬৮ কোটি ৫৮ লাখ ৮০ হাজার ডলার। অক্টোবরের প্রথম সাত দিনে এসেছে ৬৯ কোটি ২০ লাখ ডলার, গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৯ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। শুধু ৭ অক্টোবরেই দেশে এসেছে ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা মাসের গড় রেমিট্যান্স প্রবাহের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের এই রেমিট্যান্স প্রবাহ মূলত বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়েই এসেছে। ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক ও খোলাবাজারের মধ্যে ডলারের বিনিময় হারের ব্যবধান কমে আসায় প্রবাসীরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেলকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। বর্তমানে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রতি ডলারে পাওয়া যাচ্ছে ১২২.৮৯ টাকা, যেখানে খোলাবাজারে তা ১২৫ টাকা। এই সামান্য ব্যবধান প্রবাসীদের হুন্ডি ছেড়ে বৈধ পথে টাকা পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘প্রবাসীরা এখন হুন্ডির মতো অবৈধ উপায় পরিহার করে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠাচ্ছেন, এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য স্বস্তি এসেছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (BPM6) অনুযায়ী নিট রিজার্ভ ২৪.৯৯ বিলিয়ন ডলার।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমরা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করেছি। এর ফলে টাকার ওপর মানুষের আস্থা বেড়েছে, প্রবাসীরা ডলার আটকে রাখার প্রবণতা থেকে বের হয়ে এসেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘রেমিট্যান্স প্রবাহ শুধু বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ নয়, এটি দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতেও সরাসরি অবদান রাখছে।’
চলতি অর্থবছরের মাসভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্চ মাসে সর্বোচ্চ ৩২৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। অন্যান্য মাসেও প্রবাহ ছিল উল্লেখযোগ্য- এপ্রিল ২৭৫ কোটি, মে ২৯৭ কোটি, জুন ২৮২ কোটি, জুলাই ১৯১ কোটি, আগস্ট ২২২ কোটি, সেপ্টেম্বর ২৪০ কোটি, অক্টোবর ২৩৯ কোটি, নভেম্বর ২২০ কোটি এবং ডিসেম্বর ২৬৪ কোটি ডলার।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে সরকারের উচিত প্রবাসীদের জন্য সেবা আরও সহজ করা, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, এবং বৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর সুবিধা বাড়ানো। এছাড়া দক্ষ কর্মী তৈরি ও নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন