সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘সাইয়ারা’ ঘিরে যে অহেতুক ট্রেন্ড আর অনর্থক হাইপ তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও বক্স অফিসে চলছে এক ধরনের পরিকল্পিত প্রচারণা। মুক্তির আগেই বলা হচ্ছিল, এই ছবি নাকি আগাম টিকিট বিক্রিতে রেকর্ড গড়েছে, নতুন প্রজন্মের মনস্তত্ত্ব ও হৃদয়কে নাড়া দিয়ে বাজিমাত করে ফেলেছে। কিন্তু বাস্তবে হলে গিয়ে দর্শকেরা যেটা দেখেছে, তা একেবারেই উল্টো। এক ফাঁপা গল্প, অতিনাটকীয় দৃশ্য আর অপ্রাসঙ্গিক আবেগ নিয়ে সাজানো হয়েছে এই ছবি, যার গভীরতা প্রায় শূন্য।
ছবির কেন্দ্রে আছেন কৃষ কাপুর নামে এক তরুণ রকস্টার চরিত্র। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আহান পান্ডে, যিনি আসলে বলিউডের চিরচেনা নেপোটিজম সংস্কৃতিরই এক সাম্প্রতিক সংযোজন। তিনি চাঙ্কি পান্ডের ভাগ্নে এবং অনন্যা পান্ডের ভাই।

এই তারকা-পুত্রের অভিষেক নিয়েও ছিল অপার কৌতূহল, কিন্তু তার অভিনয় নিয়ে যতই আলোচনা হোক না কেন, তা একেবারেই মৌলিক বা মুগ্ধকর কিছু নয়। বরং পর্দায় তাকে দেখে বারবার মনে পড়ে বলিউডের অন্য নেপো বেবিদের কথা-যেমন অর্জুন কাপুর, অনন্যা পান্ডে, খুশি কাপুর প্রমুখ।
তবে সত্যি বলতে গেলে, তাদের তুলনায় আহানের অভিনয়ে কিছুটা আত্মস্থ ও ক্যামেরার সামনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের ইঙ্গিত আছে, যেটুকু ইতিবাচক দিক বলা যায়।
ছবিটির নায়িকা অনিত পাড্ডা প্রথম আলোচনায় আসেন ‘বিগ গার্লস ডোন্ট ক্রাই’ নামের একটি ওয়েব সিরিজে অভিনয়ের মাধ্যমে, যেখানে তার সাবলীল উপস্থিতি প্রশংসিত হয়। ‘সাইয়ারা’তেও তার চেহারা ও ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট, কিন্তু চরিত্রের গভীরতা না থাকায় অভিনয়ের পূর্ণ সম্ভাবনা প্রকাশ পায়নি।
ছবিতে দেখা যায় তিনি বারবার দুঃখভারাক্রান্ত মুখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে যেন প্রাণ নেই। আবেগ প্রকাশে তিনি যতটা আন্তরিক, চিত্রনাট্য ততটাই একঘেয়ে ও সীমাবদ্ধ, ফলে তার অভিনয় হয়ে পড়ে অনুভূতিশূন্য।

তবে ছবির সমস্যার মূল শেকড় গল্পের কাঠামোতেই। ‘সাইয়ারা’র মূল কাহিনি মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত ছবি ‘আ মোমেন্ট টু রিমেম্বার’-এর কপি, যা ইতিমধ্যেই একাধিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এমনকি ছবির সংলাপ, ক্যামেরা মুভমেন্ট, আবেগ প্রকাশের ধরন-সব কিছুতেই সেই অনুকরণের ছাপ এতটাই প্রকট যে অনেক দর্শকও রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠেছেন
এই সিনেমা নাকি একটি ‘সাংগীতিক প্রেমকাহিনি’। অথচ, যেই সংগীতকে কেন্দ্র করে ছবির আবেগ দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল, সেই সংগীতই সবচেয়ে দুর্বল। গানের তাল-মেল নেই, আবেগের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই, এমনকি ছবির শেষেও দর্শকের মনে কোনো সুর গেঁথে থাকে না। বরং পুরনো ‘সাইয়ারা ম্যায় সাইয়ারা’ গানটাই মাথায় ঘুরতে থাকে।
পর্দায় আহান-অনিতের রসায়ন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রথম দিকে কিছুটা আকর্ষণ তৈরি হলেও, চরিত্রগুলো ক্লাইম্যাক্সের দিকে যত এগোয় ততই যেন আবেগের জায়গা হারিয়ে ফেলে। প্রতিটি দৃশ্যই যেন একটি ক্লাইম্যাক্স, যার কোনওটিতেই দর্শক খুব বেশি আবেগ অনুভব করেন না, কারণ পরের মুহূর্তেই সেখানে ঢুকে পড়ে অতিমাত্রায় নাটকীয়তা।

সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়, এত অগভীর এক প্রজেক্টকে ঘিরে নির্মাতারা যে ধরণের হাইপ ও কৃত্রিম জনপ্রিয়তার প্রলেপ দিয়েছেন, তা বলিউডের বাণিজ্যিক মনস্তত্ত্বকে স্পষ্ট করে তোলে। বক্স অফিসে ছবিটি ২০০ কোটির বেশি সংগ্রহ করেছে বলেও দাবি করা হচ্ছে, কিন্তু সেই দাবির বাস্তব ভিত্তি নিয়েও ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে।
এই অবস্থায় বলা যায়-‘সাইয়ারা’ একেবারে মোহিত সুরির পুরনো ছকের পুনরাবৃত্তি, যেখানে আধুনিক প্রজন্মের মুখোশে তুলে ধরা হয়েছে ক্লিশে সংলাপ, ফাঁপা আবেগ ও নকল গল্প। এই ছবি হাইপের জন্য তৈরি হয়েছে, হিউম্যান এক্সপেরিয়েন্সের জন্য নয়।
তথ্যসূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া, আউটলুক ইন্ডিয়া, বলিউই ডটকম, বলিউড হেল্পলাইন।
আপনার মতামত লিখুন :