ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫

সুন্দরবনে বাঘ বাড়লেও হুমকি দ্বিগুণ, পাচারকারীরা সরব

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২৫, ১২:৫৭ পিএম
সুন্দরবনের বাঘ। ছবি- সংগৃহীত

আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব বাঘ দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের সমৃদ্ধি’। তবে বাস্তবতা হলো, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা সামান্য বেড়লেও তাদের জীবনের হুমকি আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়েছে।

সর্বশেষ ক্যামেরা ট্র্যাপিং জরিপে দেখা গেছে, গত বছর সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৫টিতে। যা ২০১৮ সালের তুলনায় (১১৪টি) বেড়েছে ১১টি। তবে বাঘ হত্যার ঘটনা ও পরিবেশগত চাপ এ সংখ্যা বাড়ার সুফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

পাচারকারীদের হাতে মৃত্যু

বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত আড়াই দশকে সুন্দরবনে ৬২টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে ২৬টি বাঘ মারা গেছে পাচারকারীদের হাতে, ২১টি স্বাভাবিকভাবে, ১৪টি গ্রামবাসীর হাতে এবং একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে।

বাঘের চামড়া, দাঁত ও হাড় পাচারের ঘটনায় বহুবার মামলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসামিরা আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাচ্ছেন। গত ১৫ বছরে বাঘ হত্যাসংক্রান্ত ১৯টি মামলার মধ্যে ১০টির রায় হয়েছে, এর মধ্যে ৬টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। বাকিগুলো এখনো বিচারাধীন।

বাড়ছে মানুষ-বাঘ সংঘাত

পরিবেশবিদরা বলছেন, ‘বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। কিন্তু হরিণের চোরা শিকার না থামায় বাঘের মধ্যে খাদ্যসংকট তৈরি হচ্ছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, ‘বাঘের খাদ্যের ৭৮ শতাংশ আসে হরিণ থেকে। এ ঘাটতি পূরণে বাঘ সহজ শিকারের খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে, ফলে মানুষ-বাঘ সংঘাত বাড়ছে।’

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের তথ্যমতে, শুধু ২০২৪ সালের জুন মাসেই ১৪২টি হরিণ ধরার ফাঁদ জব্দ করা হয়েছে এবং ৪১ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়েছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী জানান, ‘সুন্দরবনের চারপাশে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার বর্জ্য নদীপথে বনাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে, যা বাঘসহ বনের অন্যান্য প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।’

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় বাঘ বাধ্য হচ্ছে লবণাক্ত পানি পান করতে, যা তাদের শরীরের ক্ষতি করছে। ঘূর্ণিঝড়, জোয়ার ও নিম্নচাপের সময় নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব তাদের বেঁচে থাকার লড়াইকে কঠিন করে তুলছে।

আইনের দুর্বলতা

বাঘ সংরক্ষণের অন্যতম প্রধান বাধা হলো বন বিভাগের আইনি দুর্বলতা। মামলায় জবানবন্দি ও সাক্ষ্যের দুর্বলতায় অনেক সময় অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যায়। একাধিক মামলায় দেখা গেছে, সবার জবানবন্দি একরকম হওয়ায় তা আদালতে গ্রহণযোগ্যতা হারায়।

বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ জানান, ‘এ সমস্যা মোকাবিলায় মাঠপর্যায়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। সরকারি কৌঁসুলিদের সহায়তায় মামলা পরিচালনায় দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।’

২০২৩ সালের একটি গবেষণায় উঠে আসে, বাঘ পাচারে সক্রিয় আন্তর্জাতিক চক্র এখনো সুন্দরবনে তৎপর। ইন্টারপোলের ১৫৩ জন পাচারকারীর তালিকা থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে।

সুন্দরবন একাডেমির আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘বাঘ হত্যার ঘটনা কমেছে বটে, তবে হুমকি অনেক বেড়েছে। শুধু আইন নয়, দরকার সামাজিক সচেতনতা ও সদিচ্ছা।’

বাঘ না থাকলে টিকবে না সুন্দরবন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বাঘ হচ্ছে সুন্দরবনের কিস্টোন প্রজাতি। এটি না থাকলে বন থাকবে না, আর বন না থাকলে বাংলাদেশে পরিবেশ সংকট আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। তাঁর মতে, বাঘ সংরক্ষণে শুধু বন বিভাগ নয়, সমাজের সব স্তরের সচেতনতা জরুরি।

সর্বশেষ বাঘ শুমারিতে সুন্দরবনের ৬০৫টি গ্রিডে ১২১০টি ক্যামেরা ৩১৮ দিন রাখা হয়। এতে ১০ লাখের বেশি ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করা হয়, এর মধ্যে ৭২৯৭টি বাঘের ছবি শনাক্ত হয়। এই জরিপে ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।