ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

জামায়াতের ভেতরে-বাইরে বইছে পরিবর্তনের হাওয়া

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৫, ০৩:৪৬ পিএম
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ছবি - সংগৃহীত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে দৃশ্যমান এক নতুন ধারা শুরু হয়েছে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে। কয়েক দশকের কঠোর ধর্মভিত্তিক অবস্থান, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধি তকমা এবং মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নতা- সব পেছনে ফেলে দলটি এখন ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে ‘সংস্কারধারী রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবে। দলীয় গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন, নতুন লোগোতে জাতীয় পতাকার অন্তর্ভূক্তিসহ আরো পরিবর্তন, নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, এমনকি একাত্তরের প্রশ্নে অভ্যন্তরীণ আলোচনা- সব মিলিয়ে জামায়াতে ইসলামী যেন নতুন এক রূপে হাজির হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

গত এক বছরে দলটির সমাবেশের মঞ্চসজ্জা, পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনে লাল-সবুজের ব্যবহার বাড়তে দেখা গেছে। সর্বশেষ, দলটি জাতীয় পতাকার আদলে একটি নতুন লোগো প্রকাশ করেছে, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপটি জামায়াতের দেশপ্রেমের বার্তা দেওয়ার কৌশল এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস।

দলটির অভ্যন্তরে এখন একাত্তরের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা চলছে। দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত এ ইস্যুতে কেউ কেউ ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে, কেউ আবার এখনো এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থান বজায় রাখতে চায়।

দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, ‘৭১ বিষয় নিয়ে আমাদের আলোচনা আছে। মৌলিক কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেটা শূরা পরিষদে পাস করাতে হয়। বিষয়টি এখনও আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।’ 

অন্যদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কেন্দ্রীয় নেতা মন্তব্য করেন, ‘৭১ ইস্যুটা দিয়ে জামায়াত ও শিবিরকে ঘায়েল করার চেষ্টা হচ্ছে। তবে দেশের মানুষ এখন ট্যাগিংয়ের রাজনীতিকে গুরুত্ব দেয় না।’

এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াত এবার দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে ‘রুকন’ হওয়ার শর্ত শিথিল করেছে। এবার যোগ্য ও ন্যায়পরায়ণ যে কেউ প্রার্থী হতে পারবেন বলে জানানো হয়েছে।

এরই মধ্যে ঢাকা-৭ আসনে হাজি হাফেজ এনায়েত উল্লাহ নামের একজন ব্যবসায়ীকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে দলটি। তিনি রুকন নন, তবে জামায়াতের একজন কর্মী।

দলটির কেন্দ্রীয় নেতা মোবারক হোসাইন জানান, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সৎ, যোগ্য ও জনগণের আমানত রক্ষা করার মতো লোক খুঁজে বের করা। সেই লক্ষ্যেই পলিসি আপডেট করা হচ্ছে।’

অন্যদিকে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়েও জামায়াত এবার নতুন বার্তা দিচ্ছে। দলটির মহিলা বিভাগ এখন অনেক বেশি সংগঠিত ও সক্রিয় বলে দাবি করা হচ্ছে।

সূত্র বলছে, মহিলা বিভাগের রুকন সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার, কর্মী প্রায় ৪ লাখ, আর সহযোগী সদস্য রয়েছে বহু। বর্তমানে দলের মোট কর্মীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ৪০ শতাংশই নারী।

এ বিষয়ে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল হালিম বলেন, ‘নারীদের ভোট দেওয়ার আগ্রহ বাড়ছে। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। তাই এই অংশকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। নারীদের রুকন সংখ্যা ভবিষ্যতে পুরুষের চেয়েও বেশি হতে পারে।’

জামায়াতের গঠনতন্ত্রেও এসেছে ভাষাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। ২০০৬ সালের গঠনতন্ত্রে ইসলামী সমাজ গঠনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছিল। তবে ২০১৯ ও ২০২৪ সালের সংস্করণে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

দলটির সর্বশেষ সংস্করণে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশটি বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে... এই চেতনার ভিত্তিতে শোষণমুক্ত, ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে এই গঠনতন্ত্র প্রণীত।’

গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত স্পেনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের পেছনে দেখা যায় নতুন লোগো ও দলীয় পতাকা। লোগো থেকে আরবি শব্দ বাদ দেওয়ায় নেটিজেনদের একাংশ দাবি করেছে, জামায়াত সেক্যুলার হবার চেষ্টা করছে এবং পশ্চিমাদের আস্থা অর্জন করতে চাচ্ছে।

তবে এ বিষয়ে দলের এক শূরা সদস্য বলেন, ‘লোগো দিয়ে কোনো দলকে পুরোপুরি বিচার করা যায় না। আমরা মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই নতুনত্ব আনছি। আমাদের লোগো দেখে একটা দলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’