ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের একরোখা মনোভাবের কারণে ছাত্র-জনতার আক্রোশের মুখোমুখি হতে হয়েছিল পুলিশকে। যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হাজারের বেশি শহীদ হয়েছিলেন ছাত্র-জনতা; সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহতের তালিকায় বাদ পড়েনি পুলিশের নামও। এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের ৪৪ জন সদস্য।
হতাহতের সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটে গত ৪ আগস্ট। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় হামলা চালিয়ে ১৫ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে দুষ্কৃতকারীরা। পরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় থানায়। আতঙ্কিত পুলিশ সদস্যরা প্রাণ রক্ষার জন্য আকুতি-মিনতি জানিয়েও শেষ রক্ষা পায়নি তাদের হাত থেকে। পিটিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয় মাথা, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বীভৎস করে দেওয়া হয় মুখ-চোখ-নাক। কেটে ফেলা হয় হাত-পা।
পুলিশের এক সদস্যের মরদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয় গাছের ডালে, তিনজনের বীভৎস মৃতদেহ ফেলে দেয় পুকুরে। পুলিশ পিটিয়ে মারার লোমহর্ষক এই চিত্র শুধু সিরাজগঞ্জের অজপাড়াগাঁয়ের এনায়েতপুর গ্রামেরই নয়; নিয়নআলোর ধবধবে এই রাজধানীর বুকেও ঝুলতে দেখা গেছে পুলিশের মরদেহ।
কিন্তু যাদের কারণে, যাদের নির্দেশে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছাত্র-জনতার মুখোমুখি হয়েছিল পুলিশ; ৫ আগস্ট বেলাশেষে তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি ঢাকা শহরে। পুলিশ সদর দপ্তর ছিল ফাঁকা; ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুঠোফোন বন্ধ করে রেখেছিলেন হেড কোয়ার্টার ও ডিএমপির কমান্ডিং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সবার মুঠোফোনই ছিল বন্ধ। পুলিশ সদর দপ্তর কিংবা ডিএমপিতে কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে দলছুট হয়ে পড়েন মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। চোখের সামনে সহকর্মীদের মরদেহ এদিক-ওদিক পড়ে থাকতে দেখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তাদের মধ্যে।
৫ আগস্ট সন্ধ্যার পর থেকে ছাত্র-জনতার দখলে চলে যায় রাজধানী ঢাকা। শুধু রাজধানীতেই নয়, পুরো দেশেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পুলিশ। বাড়ে অস্থিরতা। যে সময়টাতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের পাশে থাকার কথা ঊর্ধ্বতন নির্দেশদাতাদের, সে সময়টাতে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশ পুলিশ। রাগ, ক্রোধ, ক্ষোভ, আতঙ্ক আর হতাশায় পরিণত একটি বাহিনীর সদস্যরা যখন দলছুট হয়ে যাচ্ছিল; ঠিক সেই মুহূর্তে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়া পুলিশ বাহিনীকে দলছুট না হওয়ার অভয়ের বাণী শোনাতে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের ঊর্ধ্বতন নন-কমান্ডিং কয়েকজন অফিসার। মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মুঠোফোনে কল করে আশ্বাস দিয়েছিলেন, হতাশ হওয়ার কিছু নেই, আমরা আছি তোমাদের সঙ্গে। নন-কমান্ডিং যে ক’জন অফিসার মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের ৫ আগস্ট অন্ধকার রাতে মশাল জ্বালিয়ে আস্থা ও নির্ভরতার পথ দেখিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম পুলিশ টেলিকমের (রাজারবাগ) দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল আইজি) এ কে এম শহিদুর রহমান। বর্তমানে র্যাবের মহাপরিচালকের (ডিজি) দায়িত্ব পালন করছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যখন কমান্ডিং কোনো অফিসারকে মুঠোফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন মাঠপর্যায়ের সদস্যদের শান্ত রাখতে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করেন অ্যাডিশনাল আইজি এ কে এম শহিদুর রহমান, সিআইডির পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মো. মাইনুল হাসান (বর্তমানে ডিএমপি কমিশনার), রেলওয়ের ডিআইজি মো. শাহ আলম, টেলিকমের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আকরাম হোসেন, ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি নুরুল আমিনসহ আরও কয়েকজন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন বাংলাদেশ পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আরও কয়েকজন কর্মকর্তা। দ্বিধাবিভক্ত পুলিশ বাহিনীকে সংগঠিত করতে ৬ আগস্ট সকালে মাঠে নামেন তারা। বৈঠক করেন পুলিশ অফিসার্স মেসে। সবার আগে নিহত ও আহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে রাজারবাগ নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন তারা।
সেখানকার আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়, নিহত পুলিশ সদস্যদের সৎকার ও জানাজা শেষে মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়ার। চার থেকে পাঁচটা গ্রুপ করে মরদেহগুলো উদ্ধারের জন্য পাঠানো হয় শহরের বিভিন্ন জায়গায়। ৮টি মরদেহ সংগ্রহ করে রাজারবাগ নিয়ে আসেন সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক জাহিদ। রাজারবাগে জানাজা শেষে মরদেহগুলো পাঠানো হয় স্বজনদের কাছে। ৬ আগস্ট বিকেল ৩টার দিকে সবাই মিলে একত্র হন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। আতঙ্কিত সদস্যদের আস্থা ফেরাতে সিদ্ধান্ত হয় মাঠপর্যায়ের সদস্যদের কাছে ভিডিও বার্তা পৌঁছানোর।
ভিডিও বার্তায় সহকর্মীদের উদ্দেশে এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, আমরা একটা ক্রান্তিকাল পার করছি। আমি আমার সহকর্মীদের অনুরোধ করছি, আপনার দেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে আপনাদের দায়িত্ব অব্যাহত রাখবেন। ভিডিও বার্তায় তিনি আরও বলেন, ডিএমপিতে কর্মরত যেসব পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন তাদের মরদেহ আমরা ইতোমধ্যে রাজারবাগ নিয়ে এসেছি। লাশগুলো সৎকার করে দাফনের জন্য তাদের নিজ নিজ ঠিকানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ কে এম শহিদুর রহমানের এই ভিডিও বার্তা শোনার পর কিছুটা স্বস্তি পান মাঠপর্যায়ের আতঙ্কিত পুলিশ সদস্যরা। ৫ আগস্ট রাত থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে যারা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন শহিদুর রহমানের এই ভিডিও বার্তায় কিছুটা আশ্বস্ত হন তারা। যে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে অলি-গলিতে ছোটাছুটি করছিলেন তারাও ফিরতে শুরু করেন ব্যারাক এবং পুলিশ লাইন্সে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রতন্ত্রের এমন একটা অর্গান যা নষ্ট হয়ে গেলে দেশের আঠারো কোটি মানুষের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পরত। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সে সময়টাতে পুলিশ বাহিনীর সদ্যস্যদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি ছিল। আমরা তাই করার চেষ্টা করেছি। যোগ করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট রাত থেকে অভিভাবকহীন ছিল বাংলাদেশ পুলিশ। কমান্ডিং কাউকেই মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল।