১১ বছর! ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের পাতার হিসেবে এই সময়টা অনেক লম্বা, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার তরুণ তারকা ফিলিপ হিউজের মর্মান্তিক বিদায় ক্রিকেট বিশ্বের হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, তা আজও অমলিন।
আজ ২৫ নভেম্বর, সেই ভয়াবহ ঘটনার একাদশতম বার্ষিকী। ২০১৪ সালের এই দিনে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা শুধু একটি প্রতিভাবান প্রাণকেই কেড়ে নেয়নি, বরং খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিয়ে ক্রিকেটের দৃষ্টিভঙ্গিকে চিরতরে বদলে দিয়েছে।
৬৩ নট আউট: এক নীরব বিদায়
শেফিল্ড শিল্ডের এক ম্যাচে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ব্যাট করছিলেন হিউজ। তার ব্যক্তিগত স্কোর তখন ৬৩—অপরাজিত। নিউ সাউথ ওয়েলসের পেসার শন অ্যাবটের করা একটি শর্ট বল অপ্রত্যাশিতভাবে আঘাত করে তার ঘাড়ের পেছনে।
মাঠে লুটিয়ে পড়ার পর দ্রুত তাকে সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও, বলের আঘাতে ঘটা 'ভার্টিব্রাল আর্টারি ডিসেকশন' এবং ফলস্বরূপ মস্তিষ্কে মারাত্মক রক্তক্ষরণের কারণে দুই দিন পর, মাত্র ২৫ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
হিউজের মৃত্যু বিশ্বজুড়ে এক গভীর শোকের আবহ তৈরি করে। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট অনুরাগী ও খেলোয়াড়রা #PutOutYourBats হ্যাশট্যাগে নিজেদের বাড়ির সামনে ব্যাট রেখে নীরব প্রতিবাদ জানান। এই ব্যাট হয়ে ওঠে অদম্য সাহস ও ঐক্যের প্রতীক।
নিরাপত্তা ভাবনায় আমূল পরিবর্তন
হিউজের এই ট্র্যাজেডি ক্রিকেট কর্তৃপক্ষকে খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। এই দুর্ঘটনার পরই ক্রিকেটের নিরাপত্তা প্রোটোকলে আসে আমূল পরিবর্তন।
হেলমেটের নকশা পরিবর্তন: ঘাড়ের পেছন দিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হেলমেটে বিশেষ নেক গার্ড বা 'স্টেমগার্ড' যোগ করা বাধ্যতামূলক করা হয়।
কঠোর কনকাশন প্রোটোকল: মাথায় আঘাত বা 'কনকাশন' সংক্রান্ত প্রোটোকলকে আরও কঠোর করা হয়, যেখানে দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে 'কনকাশন সাবস্টিটিউট' নামানোর নিয়ম চালু হয়।
মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: খেলোয়াড়দের মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং এ সংক্রান্ত সহায়তা আরও জোরদার করা হয়।
আজ বিশ্ব ক্রিকেটে যে উন্নত মানের সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং মাঠে দ্রুত চিকিৎসা সুবিধা দেখা যায়—তার পেছনে হিউজের সেই ত্যাগ এক বড় অনুপ্রেরণা।
অস্ট্রেলিয়া-ভারতের একাত্মতা
হিউজের মৃত্যুতে অস্ট্রেলিয়া দলের ওপর নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। শোকের আবহে পিছিয়ে দেওয়া হয় ভারতের বিপক্ষে অ্যাডিলেড টেস্ট। অবশেষে খেলা শুরু হলে অস্ট্রেলিয়া দল কালো আর্মব্যান্ড পরে এবং এক মিনিটের নীরবতা পালন করে মাঠে নামে।
সেই সিরিজে ভারতীয় দলও কালো আর্মব্যান্ড পরে অস্ট্রেলিয়ার পাশে দাঁড়ায়, যা খেলাধুলার সীমানা ছাড়িয়ে এক বিরল মানবিকতার নজির গড়ে তোলে।
অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কের কাঁপা কণ্ঠে হিউজের শেষকৃত্যে দেওয়া আবেগঘন বক্তব্য আজও ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম মর্মস্পর্শী মুহূর্ত।
১১ বছর পেরিয়েও ফিলিপ হিউজ কেবল একটি নাম নন, তিনি ক্রিকেটের বিবেক। তার না ফেরার দেশে চলে যাওয়া বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়েছে, প্রতিটি ম্যাচের জয়-পরাজয়ের চেয়েও বড় খেলোয়াড়দের জীবন ও নিরাপত্তা।




